সাধনপথে সংগীতের ভূমিকা

স্বামী মহাতপানন্দ

পৃথিবীর প্রত্যেক ধর্ম সেই ধর্মের মানুষের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। জন্মসূত্রে পাওয়া ধর্ম সাধারণভাবে মানুষকে বেশি আকর্ষণ করে। কখনাে কখনাে দেখা যায় কোন কোন ব্যক্তি যে ধর্মে জন্মগ্রহণ করেছেন পরবর্তী ক্ষেত্রে অন্য ধর্মের আকর্ষণে ধর্ম পরিবর্তন করেছেন। কয়েকজন মহান ব্যক্তি আবার যে ধর্মে জন্মগ্রহণ করেছেন সাধন বলে এমন উন্নতি ঘটিযেছেন যে তাদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই নূতন ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে। ভগবান বুদ্ধ জন্মেছিলেন হিন্দু হয়ে আবার তার তিরােধান এর সঙ্গে সঙ্গেই বৌদ্ধ ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে। ভগবান যীশু খ্রীষ্ট জন্মেছিলেন ইহুদি পরিবারে, পরবর্তীতে তাকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয়েছে খ্রিস্টধর্ম । তাই স্বামী বিবেকানন্দের একটি কথা স্মরণীয় It is good to be born in a Church but better to die outside. 

সাধকের সাধন জীবন ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সাধন জীবনে বিভিন্ন পর্যাযের মধ্য দিযে ভগবানের সঙ্গে একাত্ম অনুভব করাটাই প্রধান। বিভিন্ন ভাবের মধ্যে ভাব তন্ময়তার আতিশয্যে গড়ে ওঠে বিভিন্ন সংগীত। একটি সংস্কৃত প্রখ্যাত শ্লোক

নাহং তিষ্ঠামি বৈকুণ্ঠে যােগিনাং হৃদয়ে না চ। 

মদ্ভক্তা যত্র গায়ন্তি তত্র তিষ্ঠামি নারদ।। 

ঈশ্বরকে স্মৃতি পথে রাখিবার এই অভ্যাসের সর্বোৎকৃষ্ট সহায়ক সম্ভবত সংগীত। ভক্তির শ্রেষ্ঠ আচার্য নারদ কি ভগবান বলিতেছেন -  হে নারদ, আমি বৈকুন্ঠে বাস করি না, যােগীদিগের হৃদয়েও বাস করি না, যেখানে আমার ভক্তগণ ভজন গান করে, আমি সেখানেই অবস্থান করি।।

মনুষ্য-মনের উপর সংগীতের প্রচন্ড প্রভাব -- উহা মুহূর্তে মনকে একাগ্র করিয়া দেয়। দেখিবেন, অতিশয় তামসিক জডপ্রকৃতি ব্যক্তিগণ -- যাহারা একমুহূর্তও মন স্থির করিতে পারে না, তাহারা উত্তম সংগীত শ্রবণ করিয়া মুগ্ধ হইয়া যায়, একাগ্র হইয়া যায়। এমনকি কুকুর, বিড়াল, সর্প, সিংহ প্রভৃতি জন্তগণও সঙ্গীত শ্রবণে মােহিত হইয়া থাকে। (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা চতুর্থ খন্ড, পৃষ্ঠা ৭৪)। 

একাগ্রমনে সাধন ও ভজন সাধককে ভগবানের দিকে নিয়ে যায়। মনের একাগ্রতা নির্ভর করে প্রকৃতি পরিবেশ ভাবনা প্রভৃতির উপর। সঙ্গীত মনের একাগ্রতা সাধনে সহযােগী। স্বামী বিবেকানন্দের কথায় -- মন একাগ্র করিবার ক্ষমতা তারতম্য মানুষ ও পশুর মধ্যে প্রধান পার্থক্য। যেকোন কাজে সাফল্যের মূলে আছে এই একাগ্রতা। একাগ্রতা সঙ্গে অল্পবিস্তর পরিচয় আমাদের সকলেরই আছে। ইহার ফল প্রতিদিনই আমাদের চোখে পড়ে। সঙ্গীত, কলাবিদ্যা প্রভৃতিতে আমাদের যে উচ্চাঙ্গের কৃতিত্ব, তাহা এই একাগ্রতা প্রসূত। ..... সুললিত সংগীত শ্রবণকালে আমাদের মন সেই সঙ্গীতেই আবদ্ধ হইযা থাকে, তা হইতে মন সরাইয়া লইতে পারিনা। উচ্চাঙ্গের সংগীত বলিয়া যাহা পরিচিত, তাহাতে যাহাদের মন একাগ্র হয়, সাধারণ পর্যায়ের সংগীত তাহাদের ভালাে লাগে না। (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৩২২-২৩) 

সংগীতে মন একাগ্র হ্য, মনাে চিন্তাধারা একমুখী হয়। সাধক তাঁর চিন্তা-ভাবনাকে সুললিত ছন্দে সুন্দর সহজবােধ্য ভাষায় প্রকাশ করেন। ঈশ্বর সম্বন্ধীয় বিভিন্ন সংগীত সাধকের উচ্চতম ভাবনার ভাষায় বহিঃপ্রকাশ মাত্র। স্বামী বিবেকানন্দের কথায় -- সঙ্গীত সর্বশ্রেষ্ঠ ললিতকলা এবং যাঁরা বােঝেন তাদের কাছে অতি সবচেয়ে বড় উপাসনা। 

বর্তমানে আমরা দেখতে পাই, সাধকদের ভাবনা চিন্তা সকাল সন্ধ্যা রাত্রি এমনকি বিভিন্ন ঋতুতে প্রকৃতি ও মনের ভাবনা অনুযায়ী বিভিন্ন রাগ রাগিনীর সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে ভগবানের বিভিন্ন রূপ গুণ কে বহিঃপ্রকাশের ভাষায় সংগীতের মূৰ্ছনায়। নিরাকার ভাবনার সাধনও স্থান পেয়েছে। সাধকের জীবন সঙ্গীতময়। জীবনশৈলী ও সঙ্গীত একাকার হয়ে গেছে।

এই আলেখ্যটি শোনার জন্য নীচের Link টি click করুন -


স্বামী মহাতপানন্দ

রামকৃষ্ণ মঠ, বরাহনগর, কলকাতা ।



Comments

Popular Posts