ধ্রুপদ ও রবীন্দ্রনাথ
শ্রীসিদ্ধার্থ প্রামানিক
আমরা জানি ভারতীয় সংগীতের বিভিন্ন ধারা রবীন্দ্রনাথের সংগীত সৃষ্টিতে প্রভাব ফেলেছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছিল ধ্রুপদের। তার কারণ হিসেবে বলা যায় রবীন্দ্রনাথের বাল্যকালের জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সাংগীতিক পরিবেশ।রবীন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায় বিশিষ্ট ধ্রুপদী শিল্পী বিষ্ণু চক্রবর্তী ঠাকুরবাড়ির সংগীত শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। বিষ্ণু চক্রবর্তীর সংগীত শিক্ষা ঠাকুরবাড়িতে প্রবল উচ্ছাসে সৃষ্টি করেছিল।এরপর ঠাকুরবাড়ির সংগীত শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন বিষ্ণুপুর ঘরানার বিখ্যাত সঙ্গীত গুনী যদুভট্ট। এর সম্পর্কে কবি প্রবল প্রশংসা করেছেন। বিষ্ণুপুর ঘরানার আর এক বিখ্যাত গুণী রাধিকা প্রসাদ গোস্বামীও ঠাকুরবাড়ির সংগীত শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। বিষ্ণুপুর ঘরানা বিখ্যাত গুনী গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুযোগ্য ভাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ঠাকুরবাড়ির সংগীত শিক্ষকের ভূমিকা গ্রহণ করেন। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের বাল্যকালে ঠাকুরবাড়ির আবহাওয়া টি ছিল ধ্রুপদ গানের সুরে মুখর।
ধ্রুপদ গানের গায়নশৈলীটি তার নামের মতই স্থির ও অচঞ্চল। ধ্রুপদ এর পরিবেশনে কোনো রূপ চঞ্চলতা প্রকাশ পায় না। এই গানে রাগের বিশুদ্ধতা রক্ষিত হয় সম্পূর্ণভাবে। এই গানের বিষয় প্রধানত ভক্তিমূলক কখনো রাজা- মহারাজের স্তুতিমূলক আবার কখনো প্রাকৃতিক বর্ণনামূলক ।রবীন্দ্রনাথ ধ্রুপদের এই শান্ত ও সমাহিত ভাবটির দ্বারা আকৃষ্ট হন। দ্বিতীয়তঃ ধ্রুপদ গানের গঠন চার তুক বিশিষ্ট ।এই চারটি তুক অর্থাৎ তুলনামূলক বৃহদাকার কবিদের কবিত্ব ফলাবার পক্ষে সুবিধাজনক। সেই দিক থেকে কথা ও সুরের অর্ধনারীশ্বর রূপ সৃষ্টিকারী রবীন্দ্রনাথ এই ধ্রুপদ কে তার গানের বাহক হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তিতে তিনি বলেছেন যে ধ্রুপদ তারা ছেলেবেলা থেকেই শুনতে অভ্যস্ত। এর আভিজাত্য নিজের মধ্যে মর্যাদা রক্ষা করা। ধ্রুপদের মধ্যে দুটি বিষয় পাওয়া যায় একটি হল তার গভীরতা ও বিপুলতা অপরটি আত্মদমন ও সঙ্গতির মধ্যে আপন ওজন রক্ষা করার শিক্ষা।
রবীন্দ্রনাথ বেশকিছু ধ্রুপদ কে অনুকরণ করে রবীন্দ্রসংগীত রচনা করেছেন আবার কিছু ধ্রুপদাঙ্গের গান রচনা করেছেন যেগুলি একেবারে নিজস্ব রচনা, অনুকরণ নয়।রবীন্দ্রনাথ এই অনুকরণের ক্ষেত্রে ধ্রুপদের শান্ত সমাহিত ভাবটির দিকে লক্ষ্য রেখে ধ্রুপদের নির্যাসটুকু গ্রহণ করেছেন এর ফলে রবীন্দ্রনাথের এই গানগুলি ধ্রুপদ না হয়ে ধ্রুপদাঙ্গের রবীন্দ্রসংগীতে পরিণত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এক্ষেত্রে ধ্রুপদে গানের পূর্বে প্রচলিত নোম- তোম সহকারে দীর্ঘ আলাপটি পরিত্যাগ করেছেন। এছাড়া ধ্রুপদের প্রধান অলংকার লয়কারী ও বাটোয়ারা কবি সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। রবীন্দ্রনাথের গানে লয়কারী ও বাটোয়ারা হয় না।তালের ক্ষেত্রে ধ্রুপদাঙ্গের তাল গুলি ব্যবহৃত হয়েছে আবার তিনি নিজেও কিছু তাল বা ছন্দ সৃষ্টি করেছেন।অর্থাৎ চৌতাল, সুরফাঁকতাল, ঝাঁপতাল, তেওরার সাথে নবপঞ্চ,একাদশী,নবতাল, রুপকড়া প্রভৃতি তালের ব্যবহার করেছেন। ধ্রুপদের অপর একটি বৈশিষ্ট্য মীড়, আঁশ এবং গমক। এই অলংকার গুলি কবি ব্যবহার করেছেন কিন্তু সেক্ষেত্রে গায়ক কে পৃথক কোনো স্বাধীনতা দেননি, এগুলিকে গানের মধ্যেই বেঁধে দিয়েছেন।বিষয়গত দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ ধ্রুপদের ভক্তিপ্রাধান্যতা তার গানে বিশেষভাবে ব্যবহার করেছেন। তাই অধিকাংশ ধ্রুপদাঙ্গের গান পূজা পর্যায়ের অবশ্য প্রেম, স্বদেশ, বিচিত্র এবং আনুষ্ঠানিক পর্যায়ের ধ্রুপদাঙ্গের গানের উদাহরণও রয়েছে। এক্ষেত্রে বলাবাহুল্য রবীন্দ্রনাথ অনুকরণের ক্ষেত্রে বিষয়গত সামঞ্জস্য বিধান করেননি।প্রকৃতির গান অনুকৃত হ'য়ে পূজার রূপ নিয়েছে আবার প্রকৃতির বর্ণনা অনুকৃত হ'য়ে ভক্তিরসসিক্ত পূজার গানের রূপ নিয়েছে।
এ সম্পর্কে কয়েকটি উদাহরণ পূজা পর্যায়ের গান "আজি মম মন চাহে"- বাহার/ চৌতাল, অনুকৃত হয়েছে প্রকৃতির বর্ণনা "ফুলি বন ঘন" থেকে।
প্রেম পর্যায়ের গান "মনো জানে মনোমোহন"- নট/ চৌতাল' অনুসৃত হয়েছে ভক্তি প্রেমের গান "মন মানো মনোমোহন" থেকে।
প্রকৃতি পর্যায়ের গান "নব নব পল্লবরাজি "- বাহার/ চৌতাল, অনুকৃত হয়েছে প্রেম রসের গান "মন মথ তন দহে"থেকে।বিচিত্র পর্যায়ের গান "তিমির ময় নিবিড় নিশা" -মেঘ/ঝাঁপতাল অনুকৃত হয়েছে প্রকৃতির বর্ণনা "প্রবল দল মেঘ ঝুক"থেকে।
স্বদেশ পর্যায়ের গান "এ ভারতে রাখো নিত্য প্রভু"- সুরট/চৌতাল গানটি অনুকৃত হয়েছে একটি কালী বন্দনা গীতি থেকে "য়ে বতিয়া চিত চোরি" গানটি থেকে।
আবার আনুষ্ঠানিক পর্যায়ের গান 'সুধাসাগারতীরে হে" -নায়কি কানাড়া/ ধামার অনুকৃত হয়েছে ফাল্গুনের বসন্তের আবহে ভগবান কৃষ্ণের হোরিখেলার বর্ণনা "আয়ো ফাগুন বড় মান" গানটি থেকে।
রচনারীতির দিক থেকে আমরা জানি একটি ধ্রুপদ চার তুক নিয়ে গঠিত। রবীন্দ্রনাথের ধ্রুপদাঙ্গের গানে এই রীতি সম্পূর্ণভাবে মান্য হয়েছে। আবার দুই তুকের গানের সংখ্যাও কম নয় যেমন
"বাণী তব ধায়",
" মধুর রুপে বিরাজো" ,
"নূতন প্রাণ দাও" প্রভৃতি।
গায়ন রীতির দিক ধ্রুপদের অলংকার যেমন বাট ও লয়কারী রবীন্দ্রগানে সম্পূর্ণ বর্জিত আবার আলাপটিও রবীন্দ্রনাথ তার গানে গ্রহণ করেননি। কারণ রবীন্দ্রনাথের গান কাব্য প্রধান। অলংকার ব্যবহৃত হলে সেই কাব্যের মর্যাদাহানি হবে।
ধ্রুপদ সঙ্গীত থেকে অনুকৃত রবীন্দ্রনাথের কিছু ভাঙ্গা গানের উদাহরন দেওয়া হলো মূল গান সহ:-
"শুভ্র আশনে বিরাজো"/ "রুদ্রদেব ত্রিনয়ন",
"সংসারে কোন ভয় নাহি"/ "শ্যামকো দরশন নাহি" (আড়াচৌতাল),
"স্বামি তুমি এসো আজ"/ "স্বাই তো না আবে",
"আজি মম মন চাহে"/ "ফুলি বন ঘন" (চৌতাল),
"প্রথম আদি তব শক্তি"/ "প্রথম আদ শিব শক্তি", "সুন্দর বহে আনন্দ"/"শঙ্কর শিব পিনাকী" (সুরফাঁকতাল), "বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দ"/ "দোসহ দোখ দুখ", "তিমিরময় নিবিড় নিশা"/ "প্রবল দল মেঘ" (ঝাঁপতাল) "জয় তব বিচিত্র আনন্দ" /"জয় প্রবল বেগবতী",
"বিপুল তরঙ্গ রে"/"নাচত ত্রিভঙ্গ এ" ( তেওরা), "সুধাসাগারতিরে হে"/ আয়ো ফাগুন বঢ়ো",
"অমৃত সাগরে"/ মৈ তো না জাউ" (ধামার),
"নিবিড় ঘন আঁধারে"/ "জ্য়তি শতদল কমল" (নবতাল/ঝাঁপতাল) প্রভৃতি। রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু গান রয়েছে যেগুলো নিজস্ব রচনা , অন্য কোন গানের অনুকরণে তৈরি নয় যেমন "ভয় হতে তব অভয় মাঝে", "হেরি অহরহ তোমারি বিরহ", "স্বরূপ তার কে জানে" "তোমারেই করিয়াছি জীবনের"
"আমার বিচার তুমি করো" "জননী তোমার করুণ" "দুয়ারে দাও মোরে রাখিয়া" "প্রেমে প্রনে গানে গন্ধে" "গভীর রজনী" প্রভৃতি।
এই আলেখ্যটি শোনার জন্য নীচের Link টি click করুন -
সিদ্ধার্থ প্রামানিক
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী গ্রহণ ও পাশাপাশি স্বর্গীয় অজিত কুমার পাত্র, অমিয় রঞ্জন দাশগুপ্ত, মায়া সেন,।শ্রীমতি সমিতা মুখোপাধ্যায়,শ্রীযুক্ত আশীস কুমার ভট্টাচার্য, শ্রীযুক্ত জগন্নাথ দাশগুপ্তের কাছে সংগীত শিক্ষা।
তালের তালিম স্বর্গীয় কিংকর মাঝি, শ্রীযুক্ত কাঞ্চন দে, শ্রীযুক্ত গৌতম রায় মহাশয় এর কাছে।



বাহ্। লেখাটি বেশ ভালো হয়েছে ।রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার্থীদের কাছে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ReplyDeleteভীষন ভালো লাগলো। রবীন্দ্র সংগীত শেখার আগে ধ্রুপদ এবং কীর্তনের স্বচ্ছ ধারণা থাকা বিশেষ জরুরি। আপনি সঠিক ভাবেই বিষয় টি তুলে ধরেছেন।
ReplyDelete