যেমন দেখেছি সুচিত্রাদিকে

 


শ্রীরবীন মুখোপাধ্যায়

সুচিত্রা মিত্র। জীবিত কালেই তিনি কিংবদন্তি। তাঁর জাদু কণ্ঠে আমার শােনা প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত, 'ও আমার দেশের মাটি, তােমার পরে ঠেকাই মাথা।' শােনার সুযােগ হয়েছিল সেই শৈশবে, ওয়েলিংটন স্কোয়ার মাঠে, পঞ্চাশের দশকে। তার পর কখন যে তাঁকেই আমার সঙ্গীতগুরু বলে মেনে তাঁর পায়ে মাখা ঠেকিয়েছি, তা বুঝতে পারিনি।

সেই প্রথম তাঁকে দেখলাম। কালাে রঙের লং কোট পরে স্টেজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে খালি গলায় গাইছেন। অভিভূত হওয়ার পালা সেই শুরু। দ্বিতীয় বার মুগ্ধ হই 'সার্থক জনম আমার' গানটি শুনে - আমার পাড়ার স্কুল কালীধন ইন্সটিটিউশনে। সুচিত্রাদিও সে সময়ে থাকতেন স্কুলটির পাশেই। প্রথম বিস্ময়ের সেই ঘাের কাটার অল্প দিনের মধ্যেই সুযােগ এল তাঁর সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয়ের। রবির্তীর্থের প্রথম যুগে ১ নম্বর এস আর দাস রােডে ক্লাস হত। তারই সূচনা উপলক্ষে গুণীজন সমবেত হয়েছিলেন, একটি খাওয়া-দাওয়ার অনুষ্ঠানও আয়োজিত হয়েছিল। সেখানেই গুরুজনদের অনুরােধে আমার সুচিত্রাদিকে গান শােনানাের সৌভাগ্য হয়েছিল। সেটি ছিল একটি শ্যামাসঙ্গীত- 'আর কবে দেখা দিবি মা।' তখনই সুচিত্রাদি ও রবিভীর্থের আর এক স্থপতি দ্বিজেন চৌধুরী আমাকে রবির্তীর্থে গান শেখার জন্য সাদর আহ্বান জানালেন। 

১৯৫৭ সালে সেই আমার রবিভীর্যে প্রথম পদার্পণ। সুচিত্রাদি-দ্বিজেনদা স্নেহভরে গান শেখাতেন। বাকি ছাত্ররা ছিল আমার থেকে বয়সে অনেকটাই বড়। তাদের সঙ্গে বসে ক্লাস করতে কিছুটা অস্বস্তি হত বলে অনেক সময়ে যেতাম না। তার পরই পাড়ায় সুচিত্রাদির সামনে পড়ে যেতাম - খপ করে হাতটি ধরে বলতেন, “কী রে ক্লাসে এলি না কেন?” যথারীতি আবার ক্লাসে হাজির হতাম। এই ভাবে কখন যেন সুচিত্রাদি ও রবিতীর্থের সঙ্গে আত্মিক বন্ধনে জড়িয়ে পড়লাম। সুচিত্রাদির জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই বন্ধন উপেক্ষা করার সাধ্য আমার ছিল না। তাঁর জাদু-কণ্ঠ, দৃপ্ত ব্যক্তিত্ব, গান শেখানাের অসামান্য দক্ষতা, শিক্ষক হিসেবে আমি রবিতীর্থে যােগ দেওয়ার পরে অনুষ্ঠান পরিচালনা ও অন্যান্য ব্যাপারে আমার প্রতি তাঁর আস্থা সব কিছুই গুরু-শিষ্যের মধ্যে এমন এক সম্পর্ক তৈরি করেছিল, যা আমার কাছে আজও অমলিন। 

১৯৫৯ সাল থেকে রবিতীর্থ উঠে আসে ৩৭ নম্বর পরাশর রােডের এখনকার ঠিকানায়। ১৯৬৩ সালে আমার মা আমাদের মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন। তখন খুব অসহায় লাগত। ভারাক্রান্ত মনকে নিজের বশে আনার একমাত্র পথ খুঁজে পেয়েছিলাম রবির্তীর্থে। যখন-তখন সেখানেই ছুটে যেতাম সুচিত্রাদী-দ্বিজেনদার সান্নিধ্য পেতে। এই ভাবেই নিজের অজান্তে সম্পূর্ণ ভাবে জড়িয়ে গেলাম তাদের ও রবিতীর্থের সঙ্গে। রবীন্দ্র গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যের ভাবনার আঙ্গিক আমি আত্মস্থ করেছি সুচিতাদির কাছেই। রবিতীর্থের বার্ষিক অনুষ্ঠানে এক এক বছর নতুন নতুন ভাবে মঞ্চস্থ হত এক একটি নৃত্যনাট্য ও গীতিনাট্য। অসাধারণ স্ক্রিপ্ট তৈরি করতেন সুচিত্রাদি নিজে। কচ ও দেবযানীর গল্প অবলম্বনে বিদায় অভিশাপ, চণ্ডালিকার গল্প নিয়ে মানবকন্যা, তাসের দেশ, শাপমােচন, কালমৃগয়া, চিত্রাঙ্গদা, শ্যাম-সুচিত্রাদির সঙ্গে এই সব গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যের সফল পরিবেশনে যুক্ত থাকা নিঃসন্দেহে এক বিরল অভিজ্ঞতা, যা আমার সারা জীবনের পরম সম্পদ। ক্রমে রবির্তীর্থের যাবতীয় বেতার ও দূরদর্শনের অনুষ্ঠানের দায়িত্ব বর্তাত্ লাগল আমার উপর। বলা যায় আমি সুচিত্রাদির সহকারী পরিচালক হয়ে গেলাম। এ ছাড়া সুচিত্রাদি একক গান ও নাটকের গানে সব সময়ে আমাকে হারমােনিয়াম বাজাতে বলতেন। কিছু নাটকের গানে কণ্ঠ দেওয়ার কথাও বলতেন। 

সুচিত্রাদি সাধারণত কোনও আচার-অনুষ্ঠানে যেতে চাইতেন না। কিন্তু আমার অনেক পারিবারিক অনুষ্ঠানে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে এসেছেন। ব্যস্ততার মধ্যেও বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে গিয়েছেন। যেমন, আমার জমজ পুত্রদের অন্নপ্রাশনে উনি আমাকে জানালেন, “আমি সকালে বা দুপুরে যাব তােমার বাড়িতে। কিন্তু শর্ত। একটাই, তুমি আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে না, বুঝলে!” এলেন, ছেলেদের আশীর্বাদ করলেন, দেড়-দুঘণ্টা সকলের সঙ্গে নানা গল্প-গুজব করলেন। আর একটি বিশেষ ঘটনার কথা না-বললে এই মহীয়সী শিল্পীর উদার মনের পরিচয় পাওয়া যাবে না। ১৯৯৬ সালে আমি হঠাতই অসুস্থ হয়ে পড়ি। বুক এবং মাথার যন্ত্রণা, সঙ্গে ধুম জ্বর। সব মিলিয়ে অসম্ভব অবস্থা। আমার জামাইবাবু ছিলেন ডাক্তার। তিনি এক জন চেস্ট স্পেশালিস্টের কাছে নিয়ে গেলেন। উনি এক্স-রে করতে বলেছিলেন। এক্স-রে প্লেট দেখে নির্দিষ্ট কিছু ওষুধও লিখে দিয়েছিলেন। যথানিয়মে খাচ্ছি, তবু সুস্থতার কোনও লক্ষণ দেখলাম না। তার পর সেই ডাক্তারবাবু গােপনে আমার জামাইবাবুকে এক দুরারােগ্য অসুখের কথা বললেন। তাঁর মতে আমার অসুখটি ছিল 'লস্ট কেস'। আমার দুই ছেলে তখন খুবই ছােট, ৮-৯ বছর বয়স। সুচিত্রাদি রবিতীর্থের এক ছাত্রীর মারফত জানতে পারেন, আমি অসুস্থ। সে কথা শুনে উনি বাড়িতে ফোন করে আমার স্ত্রীকে (তিনিও ওঁরই ছাত্রী) বললেন, “হ্যাঁ রে অরুন্ধতী, রবীনের কী হয়েছে?" টেলিফোনের দুপাশে দুজনেই তখন কাঁদছেন। সুচিত্রাদি তখনই আমার বাড়ি চলে এলেন। প্রেসক্রিপশন ও এক্স-রে প্লেট দেখতে চাইলেন। বললেন, 'আমি এখনই আমার চেস্ট শোলিস্টের কাছে এ সব নিয়ে যাচ্ছি। ডাক্তার নিরুপ মিত্র, খুব বড় ডাক্তার, ওঁকে দেখাব। তুই একদম চিন্তা করিস না, কেমন।“ সুচিত্রাদি ওই দুপুরে সােজা ডাক্তারবাবুর বাড়ি গিয়ে সব দেখালেন। ডাক্তারবাবু বললেন, বিকেলে আমার বাড়ি আসবেন। এই ঘটনায় বাডির গুরুজনেরাও অভিভূত হয়ে গেলেন। যথারীতি সন্ধ্যায় সুচিত্রাদি ডাক্তারবাবুকে সঙ্গে নিয়ে চলে এলেন। ডা. নিরুপ মিত্র বিশেষ একটি ইঞ্জেকশনের কথা বললেন। তাঁর নির্দেশ মেনে সেই রাত থেকেই ইঞ্জেকশন ও ওষুধপত্র শুরু হয়ে গেল। পরের দিন সকাল বেলায়, অর্থাৎ সরস্বতী পুজোর দিন আবার সুচিত্রাদি এলেন। খুশি মনে আমার স্ত্রীকে বললেন, “বুঝলি, তুই একদম আপসেট হবি না। সব ঠিক হয়ে যাবে।" সত্যি সত্যিই কদিনের মধ্যে আমি ক্রমশ সুস্থ বােধ করতে লাগলাম। সুচিত্রাদিকে মানবরূপী দেবী ছাড়া আর কী বলব! সারা জীবন রবির্তীর্থে বহু ঘটনার সাক্ষী থেকেছি, অনেক কিছুর সঙ্গে যুক্তও থেকেছি। বহু ব্যাপারে আমার উপর দায়িত্ব দিতেন সুচিত্রাদি, যা অনেকের ঈর্ষার কারণ হত। বহু ছাত্রছাত্রী আমার বাড়িতে আসত, গান শিখত। প্রাপ্তির কথা না ভেবে আমি রবিতীর্থের বহু ছাত্রছাত্রীকে আমার কাছে ব্যক্তিগত ভাবে গান শেখার আর রবিতীর্থের অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সুযােগ করে দিতাম সুচিত্রাদির অনুমতি নিয়ে। পরবর্তী কালে কেউ বা অনেকটা এগিয়েছে, আবার কেউ হারিয়ে গিয়েছে। ঈম্বর সকলের মঙ্গল করুন, এটাই প্রার্থনা। 

শেষ জীবনে আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে সুচিত্রাদি বারবারই আমাকে বলতেন, “তুই আমাকে ছেড়ে যাবি না তাে?" সেই কথাটাই এখন সব সময়ে মনে পড়ে। এমন রসবােধসম্পন্ন, ভূবনজয়ী, সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য পাওয়া দুর্লভ। ভাগ্যবিধাতার আশীর্বাদে সেই বিরল সুযােগই আমার জীবনে ঘটেছিল।


রবীন মুখোপাধ্যায়



জন্ম দক্ষিণ কলকাতার এক সাংগীতিক পরিবারে। পিতা স্বর্গীয় ধীরেন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায়, মাতা স্বর্গীয় রাজু মুখােপাধ্যায়। মেজকাকা প্রয়াত প্রভাস মুখােপাধ্যায়ের কাছে গান শুনে বড় হয়ে ওঠা। বাড়ির অনেকেই পিয়ানাে ও অর্গান বাজাতে পারতেন।

ছােটবেলা থেকেই লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে খেলাধুলা ও সর্বোপরি সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং সেটিই হয়ে ওঠে অত্যন্ত ভালবাসার বিষয় । সেই অল্প বয়সেই নজর কেড়েছিলেন সুচিত্রা মিত্র ও দ্বিজেল চৌধুরীর । রবির্তীর্থেরও তখন বাল্যকাল । সেই সময়েই রবীনবাবু ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন রবিতীর্থ সঙ্গীত আশ্রমের সঙ্গে । পাশাপাশি ছিল বাড়ির সাঙ্গীতিক পরিমণ্ডল, যার মধ্যে বড় হয়ে ওঠেন রবীনবাবু । মেজদাদা প্রখ্যাত সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী শৈলেন মুখােপাধ্যাযের নিত্যনতুন সুরারােপ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সঙ্গীত আকৃষ্ট করত ছােট ভাইকে । এই ভাবেই বেড়ে ওঠা পরবর্তী কালের সঙ্গীতশিল্পী ও শিক্ষক রবীন মুখােপাধ্যায়ের। 

পরবর্তী কালে রবিতীর্থের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব কৃতিত্বের সঙ্গে পালন করে এসেছেন । টেলিভিশন, বেতার ও বিভিন্ন সঙ্গীত মহলে অত্যন্ত প্রশংসা অর্জন করেন। শিশুসঙ্গীত নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যাচ্ছেন আজও । সুচিত্রা মিত্রের লেখা 'আমার কথা' শীর্ষক সঙ্গীতগুলির সমস্ত সুরারােপই রবীনবাবুর । এগুলি সুচিত্রা মিত্রের পাঠের সঙ্গে সিডি আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া নিজের রচিত ও অন্যান্য বহু কবি ও গীতিকারের বেশ কিছু ছড়ায় সুর দিয়েছেন তিনি, যেগুলি শ্রোতাদের অত্যন্ত আকৃষ্ট করেছে। 'ভাবনা' রেকর্ড কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হয় সুকান্ত ভট্টাচার্যের রচনা অবলম্বনে রবীনবাবুর সুরারােপিত সিডি 'রাখাল ছেলে', যা প্রভূত প্রশংসা অর্জন করে।

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও বেঙ্গল মিউজিক কলেজের মতাে নামী প্রতিষ্ঠানের স্নাতকোত্তর স্তরের অন্যতম পরীক্ষক রবীনবাবু । সুচিত্রা মিত্রের অত্যন্ত আস্থাভাজন বলতে যা বােঝায়, এককথায় রবীনবাবু ছিলেন তাই। তাঁর সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বহু অনুষ্ঠানে নৃত্যনাট্যে সহযােগিতা করেছেন । সুচিত্রাদির অনেক একক অনুষ্ঠানে হারমােনিয়ামে সহযােগিতা করেছেন ও প্রযােজনে কণ্ঠ প্রদান করেছেন। রবীনবাবুর পরিচালনায় সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিশিষ্ট শিল্পীরা। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন স্বয়ং সুচিত্রা মিত্র, হেমন্ত মুখােপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখােপাধ্যায়, পূর্বা দাম, ঋতু গুহ, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, সাগর সেন, অশােকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়, অর্ঘ্য সেন, সুমিত্রা সেন, বাণী ঠাকুর, রমা মণ্ডল প্রমুখ । রবীনবাবুর পরিচালিত চলনাটিকা আলাদিন, চিত্রাঙ্গদা ইত্যাদি দর্শক ও শ্রোতাদের মধ্যে অভূতপূর্ব প্রশংসা লাভ করেছে।


Comments

  1. অসাধারণ একটি স্মৃতিকথা । দুর্লভ তথ্য সমৃদ্ধ । আমাদের প্রণম্যা সুচিত্রা দি কে আমাদের অনেকের সামনে তুলে আনা হল । খুব ভালো লাগল

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular Posts