চিরপ্রণম্য পূর্বাদি...যেমন দেখেছি


ডাঃ অনিতা মণ্ডল শেঠ

এক শুভ অপরাহ্নে বন্ধুর সাথে দিদির দুয়ারে উপস্থিত হয়েছিলাম প্রসাদ লাভের আশায়। সেইসময় এক সন্ত্রম মিশ্রিত সুষমামণ্ডিত মাধুর্যের বলয়ে আমি আবিষ্ট হয়েছিলাম। "সে মাধুরী চির নব'র ধারায় আমি এখনও মােহিত এবং আমৃত্যু আমি যেন এইরূপে প্লাবিত হই। দিদি" আমার মুক্তি হয়ে এলে বাঁধনরূপে"।

প্রাথমিক জড়তা বিলুপ্ত হয়ে এক মাতৃসমার আশ্রয়স্থলে উপনীত হয়েছিলাম। ক্লাসের শেষে দিদির সাথে প্রায়শই নানা কথার আদানপ্রদান - স্মৃতির ঝাঁপির উন্মােচন, আমাদের কাছে ছিল বাড়তি অক্সিজেন । মাঝে মাঝে বলতেন, "যা তাে তােরা, বাড়িঘর নেই নাকি?"

ছােটবেলায় ময়মনসিংহে দাদুর সাথে হাতির পিঠে চেপে প্রাতঃভ্রমণে যেতেন। মায়ের কাছেই প্রথম গানের পাঠ নিয়েছিলেন। ওনার মা ছিলেন রবীন্দ্রগানের পরম ভক্ত । ছােটবেলায় পড়ে গিয়ে শিরদাঁড়ায় চোট পাওয়ায়, বেশ অনেকদিন দিদিকে প্রতিকারস্বরূপ শয্যাগ্রহণ করতে হয়েছিল। প্রাণসংশয়ও ছিল। সে এক অসহ্য কষ্টের দিন দিদি যাপন করেছিলেন । সে গল্পও শােনাতেন। ছাত্রী হিসেবে দিদি , সুচিত্রাদির কাছে কি ভাবে গান শিখেছেন, শােনাতেন সে গল্পও। বলতেন, "তােরা, আমি বলে পার পেয়ে গেলি। গান মুখস্থ ক'রে খাতা বন্ধ ক'রে গান দিতে না পারলে, সুচিত্রাদি যেভাবে বকতেন, তাতে চোখে জল এসে যেত "।

দূরের ছাত্রীরা ক্লাসে এলেই আগে চলত কুশলাদিব পর্ব। আমাদের ক্লাসের শ্রীরঞ্জনী রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস করে হাঁফাতে হাঁফাতে প্রবেশ করতেই উদ্বিগ্ন দিদির কত প্রশ্ন - "তাের তাে লিভারটা ভাল নয়, খাওয়া দাওয়া ঠিকমত করছিস তাে? অতটা জল নিয়ে যাতায়াত করিস কি করে " - এমন আরও প্রশ্ন ?

এইরূপ, সকলের ছােটখাটো ব্যক্তিগত অসুবিধেগুলি দিদির অজানা থাকত না। এবং প্রত্যেকের জন্য তাঁর হৃদয়ে কোথাও না কোথাও থাকত ঠাঁই। তাঁর এই মহানুভবতা, হৃদয়ের বিশালতায় আমি অবাক মানি।

কখনও বলতেন," দেখ তােরা কত কিছু ক'রে গানের চর্চা করছিস, আমি তাে কিছুই করি না" | হতবাক হতাম, লজ্জায় মাটিতে মিশে যাবার যােগাড় । আসলে উত্তম তাে এইভাবেই চলেন অধমের সাথে। যদি কখনও কোনও একটি বিশেষ গান শেখানাের অনুরােধ করতাম , তখনই একটু মিষ্টি হেসে বলতেন , " ওরে, এত শক্ত গান আমি গাইতে পারি না রে" | দিদির এই বিনয়ই আমাদেরকে ওনার এত কাছাকাছি রেখেছিল । অত বড় মাপের একজন শিল্পীর বহিরাবরণের সরলতা আমার মত অর্বাচীনের সাহস জুগিয়েছিল।

একবার "কী সুর বাজে" গানটি শেখানাের কালে, গানটির কথা এবং সুরের মূর্ছনায় আমরা মুগ্ধতা প্রকাশ করলে দিদি মজা করে বল্লেন , " ওরে, বুড়োটা কবেই আমাদের সব ভাবনাগুলি বুঝে ওর নিজের মত করে, কত কীই করে গেছেন, লিখে গেছেন। আমাদের জন্য আর অবশিষ্ট কিছু রাখেন নি, বুঝেছিস?"

পরের দিকে পুরোনাে আর্থ্রাইটিসের ব্যথা দিদিকে খুব ভােগাতে শুরু করে। মাঝে মাঝে বলতেন, "তােরা বুঝবি না, আমার কতটা কষ্ট হচ্ছে "| বলতাম , "দিদি আজ আর ক্লাস করব না" | সঙ্গে সঙ্গে বলতেন , " ব্যথা তাে থাকবেই , তােরা না এলে আমার ভাল লাগবে না " | দু পায়ের knee replacement এর পর ওঁনার হাঁটুর ব্যথা একটু কমলেও অন্যান্য joint pains একটুও কমে নি। নিয়মিত বিশিষ্ট অস্থি - বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতেন এবং পথ্যাদি করতেন । Physiotherapyর সময় adjust কবে আমাদের ক্লাস নিতেন । Physiotherapy দিদির কাছে খুব painful ছিল। কোথাও যেতে পারতেন না বিভিন্ন শারিরীক সমস্যার কারণে।

পুজাের ছুটি এবং লক্ষীপুজোর পরে দিদির কাছে যাওয়ার জন্য থাকত বিশেষ আমন্ত্রণ । এবং আমরাও সাগ্রহে অপেক্ষা করতাম। নিজের হাতে সুস্বাদু নিমকি, গঙ্গা, মিষ্টি , পায়েস ঘুঘনি আরও কত কী বানাতেন এবং পরিবেশন করতেন। কুণ্ঠা ভ'রে দিদির কষ্টের কথা উল্লেখ করলে বলতেন , "একদম বলবি না। সারা বছর তােরা আসিস , কিছু তাে আমি করতে পারি না। এই দিনটিতে আমি যতটুকু যতদিন পারি করে যাব, তােরা বাধা দিবি না"| অসহায় দৃষ্টিতে বুবুনের দিকে তাকালে ও প্রশয়ের হাসি হেসে বলত ," মা কে বললেও , শুনবে না'

আবাসনের দুর্গোৎসবে দিদি সকলের অনুরোধে অনুষ্ঠান করতেন। ওনার বাড়িতেই চলত রিহার্সাল পর্ব। খুব আনন্দ সহকারে দিদি সমগ্র অনুষ্ঠানে যােগদান করতেন। পরের দিকে হাঁটা চলার কষ্ট উত্তরোতর বৃদ্ধি পাওয়ায় দিদির অনুপস্থিতি দিদিকে এবং আবাসিকবৃন্দকে গভীর মানসিক পীড়া দিয়েছে। একটি ঘটনা উল্লেখের দাবি রাখে। আমাদের বন্ধু রবীন্দ্রানুরাগী, সুগায়িকা প্রবাসী অনুবাধা বালিগঞ্জে নিজের বাড়িতে, বহু গুণীজনের উপস্থিতিতে 'বর্ষামঙ্গল' অনুষ্ঠান করে। গত ২০১৬তে ও আমাদের অনুরােধ জানালাে পূর্বাদিকে কোনভাবে যদি অনুষ্ঠানে হাজির করানাে যায়। আমরা ওনাকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নেওয়াতে, অনেক যন্ত্রনা সত্ত্বেও দিদি রাজী হয়েছিলেন। অনুরাধার বাড়িতে যাওয়ার দিন দিদির আনন্দের সীমা ছিল না। আমাদের পাশে নিয়ে পােশাক চয়ন, পরিপাটি স্নিগ্ধ সাজ দিদিকে এক লহমায় সকল যন্ত্রনা থেকে যেন মুক্তি দিয়েছিল। অনুরাধার দিত্বলের বাড়িতে বাহক বাহিত হয়ে দিদি যেন তখন সম্রাজ্ঞীসম আসনে বিরাজমান। গান ধবলেন , " আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে " | তখন কারুর বােঝার ক্ষমতা নেই, কতটা ব্যথা বেদনায় ক্লিষ্ট উনি।

ক্রমশঃ সকল শারিরীক কষ্ট সহ , স্মৃতিভ্রংশের শিকার হচ্ছিলেন দিদি। পূর্ব স্মৃতি আওরালেও, বর্তমান হাতড়াতে হ'ত। কিন্তু গানগুলি গাইতেন নির্ভুল।।

২০১৬র ২৩ শে জানুয়ারী , পূর্বাদির জন্মদিন পালন করি আমরা। কেক কাটা, সকলকে খাওয়ানাে , হাসি, আনন্দে ভ'বে বইল সেদিনের সন্ধ্যেটা। তারপর আর সেরূপ ভাবে দিদির জন্মদিন পালন করা যায় নি।

সকল গুণীজনে যেমন দিদির গানের কদর করেন , আমার কাছে তার অন্যথা নেই। তবে দিদি যেন মাতৃসমা গুরুর ভূমিকা ছাপিযেও আমার কাছে এক অন্যজন, বড়ই কাছে, বড়ই আপনার। তাঁর বিদায়বেলায় ঘরের কোণে বাঁধভাঙা চোখের জলে ভেসেছি। কিন্তু জানি তাে, "তােমার যাওয়া তাে নয় যাওয়া।"

এ ক্ষুদ্রের লহাে নক্ষস্কার। রইল অন্তরের অন্তঃস্থলের সশ্রদ্ধ প্রণাম।


ডাঃ অনিতা মণ্ডল শেঠ



পেশায় চিকিৎসক , মননে সঙ্গীত , নেশায় ভ্রমন লেখালেখি আর বাগান চর্চা ।


Comments

  1. অপূর্ব
    তোমার লেখা পড়ে পুরান দিন গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠলো।

    ReplyDelete
  2. Lekha eto pranobanto ..mon chhuye gelo.ami Purbadi ke amar antarer shrrodha o pronam janai..

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular Posts