সঙ্গীতগুরু সাগর সেন-যেমন দেখেছি
শ্রীনয়ন রঞ্জন মুখোপাধ্যায়
মনে আছে ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমার সৌভাগ্যে হঠাৎ এসে পড়েছিলাম "রবিরশ্মি" তে।
বরেণ্য রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সাগর সেনের স্কুলে, যিনি আমাদের সকলের খুব কাছের মানুষ সাগর দা। তখন সবে স্কুলের গন্ডী পেরিয়ে কলেজে প্রবেশ করেছি। বাড়িতে নিজের চেষ্টায় কিছু কিছু গান শিখেছি , রেডিও তে গান শুনে। কিন্তু প্রথাগত শিক্ষার শুরু হয় নি। বললেন একটা গান গাও দেখি। হারমোনিয়াম বাজাতে পারো? বললাম "হ্যাঁ পারি"। ওনার হারমোনিয়াম নিয়েই গাইলাম --"দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায়"। স্কেল সম্বন্ধে ধারনা মোটেই ছিল না..,বাড়িতে একটা পুরোনো বক্স হারমোনিয়ামে বাজানোর অভ্যেস ছিল।উনি আমার স্কেল টা ঠিক করে দিয়ে আবার গাইতে বললেন, গাইলাম , মনে হল খুশীই হলেন হয়ত। সেদিন ছিল রবিবার, ক্লাসে গান শিখতে লেগে গেলাম। প্রথম গান- "হে ক্ষণিকের অতিথি"।
সাগর দা'র ক্লাসে যাবার মূলে আমার কাকার বিশেষ অবদান ছিল। কাকার সাথেই গিয়েছিলাম মহানির্বান রোডের ক্লাসে, রবিরশ্মিতে। তার পরের কয়েক বছর আর কয়েক মাস আমার জীবনের অনন্য স্মৃতি।
ক্লাসে আমাদের তেমন ভীষণ কড়াকড়ি কখনো ছিল না, স্বরলিপি ক্লাসে ফলো করার ব্যাপারে সাগর দা কখনোই কোনো জোর করেন নি। নিজের মুখে একটি করে গানের কলি গেয়ে শোনাতেন, সেখান থেকে আমরা সবাই শুনে শুনে শিখতাম। তারপর প্রত্যেককে আলদা করে ধরে
শুনতেন ।আমার আগের ছাত্র বা ছাত্রী কেউ গাইবার সময় বুক ঢিপঢিপ করত, পারব তো? সেই "কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো"র পথেই আমাদের শিক্ষা ক্রম, গল্পে গানে ভরে থাকত দিনগুলি। আনন্দ মুখর হয়ে উঠত ।
একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয় ছিল যে সাগর দা গান শেখার পন্থা হিসেবে শোনবার দিকে নজর অনেক
বেশী দিতেন। ক্লাসঘরের আলমারিতে সব স্বরবিতান থাকত। যখন যে গান শেখানো হবে সেই স্বরবিতান নামানো হত। উনি সেখান থেকেই গেয়ে গেয়ে শোনাতেন। আমরা শুনতাম আর অলক্ষ্যে কোথায় মনের মধ্যে চলে যেত গানগুলি।আমি দেখেছি, সাগর দা'র নিজের রেকর্ডিং এর কিছু কিছু গান আমাদের আগে থেকেই শেখাতেন। অর্থাৎ ক্লাসে বার বার অনুশীলন হতে হতে গানগুলি সকলের কাছেই সহজ হয়ে উঠত। কোনো এক মুহূর্তে উনি বলেছিলেন যে ক্লাসে যে আমি শুধু গান শেখাই তা নয়, এক একজনের বিশেষ গায়কী আমি মন দিয়ে শুনি এবং সেখান থেকেও কিছু নেওয়ার থাকলে নিয়ে নিই।
কিন্তু আমাদের শিক্ষা শুধু ক্লাসে শেখা নয়, নানা ধরনের অনুষ্ঠানের রিহার্সাল ছিল আমাদের শিক্ষার অঙ্গ। আমার মনে আছে রবিরশ্মির রেডিও প্রোগ্রামের জন্য আমরা শিখেছিলাম..."আলোকের এই ঝর্ণাধারায়" "আপনাকে এই জানা আমার" "অরূপবীণা রূপের আড়ালে", এ সমস্ত নানা ধরনের রিহার্সালের কারণেই আমাদের গানের সঞ্চয় খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে উঠত।
শাপমোচন নৃত্যনাট্য কয়েকবার হল। তাতে আমরা কোরাস গান করতাম আর রিহার্সাল দেখতাম। রিহার্সাল দেখতে দেখতে মনের মধ্যে কোথায় যেন তৈরী হতে লাগলো নতুন শিক্ষা, শুধু গান শেখা নয়, কি ভাবে পুরো অনুষ্ঠানটি ঘটানো হয় তার শিক্ষা।
আমাদের বার্ষিক অনুষ্ঠানের নাম "শ্রাবণসন্ধ্যা" । এই অনুষ্ঠান তখনকার দিনে কিভাবে করানো হত ভাবলে আজও মনের মধ্য অনুরণন ওঠে। অনুষ্ঠানের ভিতরে এবং বাইরে আমরা কাজ করতাম,সুভেনির টিকিট ,বুকিং,অ্যাডভ্যাটাইসমেন্ট জোগাড় সবেতেই ছিল আমাদের অবাধ গতি, গানের রিহার্সাল হত,অনুষ্ঠানে সব বড় শিল্পীরা আসতেন, যারা সকলেই বিশিষ্ট এবং প্রবাদপ্রতিম। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দোপাধ্যায়, বাণী ঠাকুর, পূর্বা দাম প্রমুখ।
রবীন্দ্রসদন স্টেজের একধারে আমরা প্রায় চল্লিশ জন ছাত্রছাত্রী, অনেক যন্ত্রশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, বাচিক শিল্পী আর এই প্রবাদপ্রতিম কন্ঠশিল্পীরা কখন কিভাবে আসবেন, যাবেন, বসবেন এগুলি যেন ছবির মত ছকে ফেলতেন সাগর দা । একজন সঙ্গীতশিক্ষক যে কিভাবে এত বড় মাপের পরিচালক হতে পারেন তা আমরা চোখের সামনে দেখতাম। অতবড় একটা লাইভ অনুষ্ঠান,
হলভর্তি দর্শকের সামনে কেমন নিঁখুত ভাবে পরিবেশিত হত তাই দেখে আমরা স্তম্ভিত হতাম।
আমাদের গানের শিক্ষা শুধুই ক্লাস ভিত্তিক কখনও ছিল না। সাগরদার মধ্যে চার রকমের ব্যক্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিলাম আমি, সঙ্গীতশিক্ষক, পরিচালক, বরেণ্য শিল্পী আর অভিভাবক ।এই চারমুখী ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে থাকতে থাকতে ভেতরে সঞ্চিত হত নানা ধরনের নতুন শিক্ষার ক্ষেত্র। আমাদের খুব কাছের মানুষ ছিলেন তিনি। ওনার বাড়িতে সবসময়ই ছিল আমাদের অবাধ গতি। একবার আমাদের ক্লাসের দাদা দের..অমিত দা ,অশোক দা, রবিন দা , আমাকে আর আমার
সমবয়সী আরো দুজনকে বললেন, চলো ম্যাটিনি শো তে সিনেমা দেখব। নিউ এম্পায়ারে সিনেমা দেখে বেরিয়ে উল্টোদিকের রেষ্টুরেন্টে চ সিঙাড়া খেয়ে বাড়ি ফেরা।
আসানসোল গেলাম গান নাচের শিল্পীরা মিলে, শাপমোচন নৃত্যনাট্য হবে, আর সাথে সাগরদা চিন্ময়দার গান। নাচে ছিলেন অসিত চট্টোপাধ্যায়, ভাষ্যে পার্থ ঘোষ , গৌরী ঘোষ। সাগরদার তিন ছেলে প্রিয়ম প্রীতম আর প্রমিত এরাও ছিল আমাদের সাথে। প্রথমে গিয়ে আমরা একটা স্কুলবাড়িতে উঠেছিলাম বেশ মনে পড়ে, ভীষণ ঠান্ডা, সাগর দা বেশ জমিয়ে আড্ডা শুরু করে দিলেন.. বললেন সবাই একটা করে জীবনের অভিজ্ঞতার স্মরণীয় ঘটনার কথা বলো, আমি একটা ঝড়ের অভিজ্ঞতার কথা বললাম। গল্পের মাঝে বৌদির হাতে গড়া কিছু খাবার আমাদের সাথে ভাগ করে খেলেন।
শাপমোচন আর শ্রাবণসন্ধ্যা ছাড়াও আরো অনেক অনুষ্ঠানের সাক্ষী ছিলাম। " স্বদেশী নেয়ে বিদেশী খেয়া" , "ঋতুরঙ্গ" ,"গানের ঝরণাতলায়" ইত্যাদি।
একবার চন্ডালিকায় উনি নিজে না গেয়ে আনন্দ'র গান আমাকে দিয়ে গাওয়ালেন, রবীন্দ্রসদন মঞ্চে।
এমন ভাবেই আরও কতদিন কিভাবে কেটে যেত জানি না, হঠাৎই একদিন জানতে পারলাম উনি মারণ রোগে আক্রান্ত। কিন্তু তা সত্বেও ওনার মধ্যে কোনোরকম দুর্বলতা দেখি নি, জীবনের প্রতি বিশ্বাস হারান নি উনি। ১৯৮৩'র জানুয়ারী মাসে সকলকে শোকাহত করে বিদায় নিলেন অকালেই।
এ এক বজ্রপাতের মত আমাদের স্তম্ভিত করল।
এখন দেখি আমরা যারা ওনার স্মৃতি বহন করি আর রবীন্দ্রনাথের গানকে আশ্রয় করে আরও একটু এগোনোর চেষ্টা করি সেখানেই সাগর দা বেঁচে আছেন, ওনার অকালমৃত্যু শুধুই বাহ্যিক একটি ঘটনা মাত্র।
এই আলেখ্যটি শোনার জন্য নীচের Link টি click করুন -
আগমণী গান - সোনার আলোর রথেতে এসো গো মা
কথা - সোমা মুখোপাধ্যায়
সুর ও কন্ঠ - নয়ন রঞ্জন মুখোপাধ্যায়
কথা - সোমা মুখোপাধ্যায়
সুর ও কন্ঠ - নয়ন রঞ্জন মুখোপাধ্যায়




লেখাটা পড়লাম । স্মৃতি চয়ন ও গানটা আত্মজীবনী। খুব ভালো লাগলো ।
ReplyDeleteঅসধারণ স্মৃতিচারণ..সেই অমূল্যসময় টুক মূর্ত হয়ে উঠল আন্তরিক কলমের মধ্যে দিয়ে..
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো..