ভরসামঙ্গল
ডা. পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার
শ্রাবণ মাসের ৩০ তারিখে অনুষ্ঠিত হবে বর্ষামঙ্গল উৎসব, শান্তিনিকেতনে। সেবার কবির শরীর বেশ খারাপ। কিন্তু প্রিয় বর্ষা ঋতুর আগমনে কবির চাতক-হৃদয় বিমুখ থাকতে পারে না, জেগে ওঠে গানের সুর। আর বর্ষামঙ্গল উৎসবের সার্থকতা তো তাঁর গানের নিবেদনেই। তাই অসুস্থতার মধ্যেও রচনা করে ফেললেন চারটি গান। শুরু হয়ে গেল বর্ষামঙ্গলের রিহার্সাল। উদয়নের পশ্চিম বারান্দা প্রতিদিন সন্ধ্যায় জমে উঠত উৎসবের কুশীলবদের আনন্দ উচ্ছ্বাসে।
রিহার্সালের পাশের একটা ঘরে কয়েকজনের তাসের আড্ডা বসত। এঁরা না পারতেন গান গাইতে না পারতেন নাচ। এই সুরহীন লোকেদের রবীন্দ্রনাথ বলতেন ‘অ-সুরের দল’। এই দলে ছিলেন আশ্রমের কিছু অধ্যাপক আর কর্মী। সেই ১৩২৮ সালে বর্ষামঙ্গল উৎসবের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বাংলার চারুকলার ইতিহাসে নূতন দিগন্তের সূচনা করবার পরে কোনোদিনই তারা এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারন নি। পাশের ঘরের আনন্দ কোলাহল শুনতে শুনতে একদিন প্রতিজ্ঞা করে বসলেন যে তারাও নাচগানের একটা অনুষ্ঠান করবেন। সকলকে দেখিয়ে দেবেন যে তাঁরাও হেলাফেলার নন। সকলে মিটিং এ বসলেন। দলের নাম ঠিক হল হৈ হৈ সংঘ। বর্ষামঙ্গলের অনুকরণে জলসার নামকরণ হল ভরসামঙ্গল। নিজেদেরই লেখা কিছু গান আর নাটকের খসড়া নিয়ে জোরকদমে শুরু হল ভরসামঙ্গলের রিহার্সাল। সে এক মজার ব্যাপার। রোজ সন্ধ্যায় কোনার্কের সামনে চালে রিহার্সাল, আর তা দেখে সামনে জড়ো হওয়া ছাত্রছাত্রীরা হেসে গড়িয়ে পড়ে। কথাটা রবীন্দ্রনাথের কানে গেলে তিনি যুবকদের এই চপলতাকে সানন্দে অনুমোদন করলেন, এমনকি তাদের উৎসাহ দেবার জন্য লিখে দিলেন গোটাচারেক হাসির গান।
আমরা না গান গাওয়ার দল, ও ভাই কানাই কারে জানাই দুঃসহ মোর দুঃখ, পায়ে পড়ি শোনো ভাই গাইয়ে আর কাঁটাবনবিহারিণী । সবকটি গান ১৩৪২ ভাদ্রের ৪ থেকে ৬ তারিখের ভিতরে লেখা। রবীন্দ্রনাথের গান আর আশীর্বাদ হৈ হৈ সংঘের সদস্যদের উৎসাহ আর রিহার্সালের ধূম বেড়ে গেল শতগুণ।
ইতিমধ্যে বর্ধমানের দামোদরে ভীষণ বন্যা দেখা দিলে অনাহারক্লিষ্ট হাজার হজার গৃহহীন মানুষের দুর্দশার সীমা রইল না। মানুষদের দুঃখে কাতর রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে ঠিক হল ভরসামঙ্গল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বন্যাপীড়িতদের সাহায্য করা হবে। নিছক বিনোদন ছাড়াও ভরসামঙ্গল মানুষের সেবার কাজে লাগবে জেনে পেয়ে হৈ চৈ সংঘের সদস্যদের আনন্দের সীমা রইল না।
৭ ভাদ্র সন্ধ্যায় ভরসামঙ্গল জলসা অনুষ্ঠিত হবে সিংহসদনে। রানি চন্দ সেই স্মৃতি ধরে রেখেছেন তাঁর লেখায়, ‘ ভরসামঙ্গলের আগের দিন বিকেলে গরুর গাড়ি করে ছাপানো বিজ্ঞাপন বিলি করল হৈ হৈ সংঘের দল সারা আশ্রম ঘুরে। ঢোল করতাল হারমোনিয়াম বাঁশি শিঙা শঙ্খ কিছুই বাদ ছিল না সেদিন সেই গোরুর গাড়ির উপরে। পরদিন শান্তিনিকেতনের শ্রীনিকেতনের যে যেখানে ছিল সবাই এসে জড়ো হল সন্ধে হতে-না-হতেই সিংহসদনে’।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সংঘের সদস্যরা অবাক হয়ে দেখলেন, যা তারা ভাবতেও পারেন নি, মঞ্চের সামনের আসনে এসে বসেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সঙ্গে রথীন্দ্রনাথ, সচ্চিদানন্দ রায়, অনিল চন্দ প্রমুখেরা। জলসা শুরু হল। সে এক লণ্ডভণ্ড ব্যাপার। যে যার খুশিমত স্টেজে ঢুকছে বেরোচ্ছে। রানী চন্দ এর অসাধারণ বর্ণনা করেছেন ‘গাংগুলীমশায় (প্রমোদলাল গাংগুলী) ডুগডুগি বাজিয়ে গান ধরলেন। গৌরদা (গৌরগোপাল ঘোষ) ভীমের বেশে গদা ঘোরাতে ঘোরাতে স্টেজে চক্কর দিয়ে গেলেন। সরোজদারা (সরোজরঞ্জন চৌধুরী) নাচলেন বাল্মীকিপ্রতিভার নাচ। তাঁদের পায়ের দাপটে স্টেজ ভাঙে আর-কি। ক্ষিতীশ (ক্ষিতীশ রায়), ডাক্তারবাবু (শচীন্দ্র মুখোপাধ্যায়), সন্তোষবাবু (সন্তোষকুমার ভঞ্জ) শাপমোচনের নকল করে নেচে নেচে গাইলেন ও ভাই কানাই কারে জানাই দুঃসহ মোর দুখ। নন্দদা (নন্দলাল বসু) সাদা সালোয়ার পাঞ্জাবি চিকনের টুপি মাথায় দিয়ে কালো চাপদাড়ি লাগিয়ে খালিফার সাজে সেলাম করতে করতে স্টেজ ভরে তুললেন। নন্দদা যেতে-না-যেতেই গোঁসাইজি (নিত্যানন্দবিনোদ গোস্বামী) দুই হাতে দুই জোড়া কাঠের বাজনা বাজারে বাজাতে এমাথা ওমাথা বিদ্যুৎগতিতে নেচে দিয়ে গেলেন’।
পাঠক, বুঝতে পারছেন কী অসাধারণভাবে জমে উঠেছিল হল হৈ হৈ সংঘের ভরসামঙ্গল জলসা। রবীন্দ্রনাথসহ দর্শকেরা প্রাণভরে উপভোগ করেছেন যুবকদের চপলতায় সৃষ্টি একট ব্যতিক্রমী আনন্দসন্ধ্যা। তবে অনুষ্ঠান শেষে রবীন্দ্রনাথকে একটি একশ টাকার চেক দান করতে হয়েছিল হৈ হৈ সংঘকে।
Dr. Purnendu Bikash Sarkar
Dr. Purnendu Bikash Sarkar is an Ophthalmologist by profession. From his early childhood he had an inquisitive and scientific attitude and made many innovative scientific models for which he received first prize and certificate from eminent scientist Sri Satyen Bose. In 1995 Dr. Sarkar established his own advanced eye hospital, Salt Lake Eye Foundation, which is one of the most renowned and well-equipped eye care center in Eastern India.
Dr. Purnendu Bikash Sarkar is an ardent lover of Rabindranath Tagore. Till eighth decade of last century, modern gadgets like TV, Computer, Internet, and Mobile were unknown. Dr. Sarkar started collecting LP, Audio Cassatas and CD of Rabindra Sangeet of renowned artistes from various sources. In 1994 after purchasing his first computer he started digital conversion of the Rabindra Sangeet from his old collections. At that same time, in spite of his busy schedule as an Eye Surgeon, Dr. Sarkar started extensive research on Tagore and his works.
Dr. Purnendu Bikash Sarkar planned to compile all Rabindra Sangeet from his digital library with other information regarding the songs, in a software to share with everybody to browse and enjoy any Rabindra Sangeet within a moment.
গীতবিতান তথ্যভান্ডার - ডাঃ পূর্ণেন্দু সরকারের এক অমর সৃষ্টি
রবীন্দ্রনাথের গান সীমার মাঝে অসীম কবির শ্রেষ্ঠ দান । জীবনের নানা মুহূর্তে আমাদের আশ্রয় । রবীন্দ্র সংগীত বিষয়ক পাঠকের আগ্রহ সীমাহীন । পূর্ণেন্দু সরকারের গীতবিতান তথ্যভান্ডার একটি নিষ্ঠাবান ও শ্রমসাধ্য কাজ ।
এই গ্রন্থে গীতবিতান এর সমস্ত গানের প্রাপ্ত যাবতীয় তথ্য গুলিকে এমন ভাবে সংকলিত করা হয়েছে যাতে যে কোন গানের নানা খবর মুহূর্তেই জেনে নেওয়া সম্ভব । নাট্যান্তর্গত সুরারোপিত সংলাপগুলির জন্য আছে আলাদা বিভাগ । রবীন্দ্রসঙ্গীতের কালানুক্রমিক বিন্যাসের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থের প্রকাশের সম্পর্ক ও নানা তথ্য গীত সমৃদ্ধ রবীন্দ্র গ্রন্থ পুনরাবৃত্ত গান এবং ভাঙ্গা গানের বিস্তারিত তালিকা আলোচ্য গ্রন্থটি কে সমৃদ্ধ করেছে ।
শুভেচ্ছাপত্রে কবি ও রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ শঙ্খ ঘোষ জানিয়েছেন, "... আমাদের নিরন্তর রবীন্দ্রচর্চার জগতে এটি একটি জরুরী কাজ হিসাবে গণ্য হবে বলে বিশ্বাস করি ।" রবীন্দ্র প্রেমীদের জন্য অবশ্য সংগ্রহ যোগ্য আকর গ্রন্থ গীতবিতান তথ্যভান্ডার।
গ্রন্থের সংকলক পূর্ণেন্দু বিকাশ সরকার পেশায় চক্ষু চিকিৎসক । গীতবিতান এর সমস্ত গান স্বরলিপি ও তথ্য সমৃদ্ধ গীতবিতান আর্কাইভের সংকলক । এছাড়াও রবীন্দ্রনাথের ৩৫০০ কবিতার তথ্য আবৃত্তি ও গানের ডিজিটাল সংকলন "রবীন্দ্রকবিতা আর্কাইভ" প্রকাশিত হয়েছে ২০১৮ সালে । ভালোবাসেন ছবি তুলতে ও নানা ধরনের গান শুনতে ।





Comments
Post a Comment