রােগ-নিরাময়ে সংগীতের ব্যবহার


ড: শমীতা মুখোপাধ্যায়

সঙ্গীতের উপস্থিতি সর্বত্র। কিন্তু সঙ্গীত বলতে আমরা কি বুঝি? অনেকে সঙ্গীতের সঙ্গে মানুষের মন এবং বুদ্ধিবৃত্তির যােগের কথা বলেছেন। সুর, ছন্দ এবং লয়—এই ত্রয়ীর সমন্বয়ে সঙ্গীত গঠিত ।

ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে সঙ্গীত চিরকালই মানুষের মনকে নাড়া দিয়ে এসেছে । সমগ্র শিল্পজগতের মধ্যে সঙ্গীত একটি প্রধান এবং চলমান শিল্প। গীত, বাদ্য এবং নৃত্যের সমাহারে সঙ্গীত হল নাদবিদ্যা। যেহেতু বৃহদ্দেশী রচয়িতা মতঙ্গ মুনি নাদকে ব্রহ্মস্বরূপের সঙ্গে একাত্ম করে দেখেছেন, সেহেতু সঙ্গীতকে আমরা ব্রহ্মবিদ্যা বলে থাকি। 

বিশিষ্ট ইউরােপীয় পণ্ডিত উইলিয়ামস্ সঙ্গীতের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, “Music is the art or Science of Singing, with music and dancing; it is sung in chorus or harmony." পাশ্চাত্যের পণ্ডিতগণ নৃতাত্ত্বিক গবেষণার মধ্য দিয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, "intensified speech” হচ্ছে সঙ্গীতের আদিরূপ । Herbert Spencer বলেছেন যে, মানুষের গলার স্বরের উচ্চতা, নীচতা, কোমল বা উঁচু পর্দার সুর যে ব্যবহার হয়ে থাকে, তা তার মানসিক ভাবের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই হয়ে থাকে।

সঙ্গীত মানুষের ইন্দ্রিয়ানুভূতিকে যেভাবে নাড়া দেয়, চিন্তাশক্তিকে যেভাবে সক্রিয় করে, অন্যান্য শিল্পকলা সেভাবে তা করতে সক্ষম হয় না। সঙ্গীত হ’ল সৃজনশীল মনের সৃষ্টি । সঙ্গীত শিল্পীর কল্পনায় জাগ্রত হয় এবং শ্রোতার কল্পনায় আবেদন করে। তাই ত কবি বলেছেন -

“একাকী গায়কের নহে তাে গান

মিলিতে হবে দুইজনে 

গাহিবে একজন খুলিয়া গলা,

আর একজন গাবে মনে ।”

শিল্পকলার এই অন্যতম প্রধান শাখাকে যে একটি অত্যন্ত মহৎ কাজে ব্যবহার করা যায়, সে নিয়ে এবার একটু আলােচনা করব, যার নাম হল ‘মিউজিক থেরাপি'। | 

ভারতবর্ষে ‘মিউজিক থেরাপি' বয়সে নবীন হলেও পাশ্চাত্যে এটি একটি বহুল প্রচলিত শব্দ এবং এর প্রয়ােগ ক্রমবর্ধমান। আমেরিকায় ‘মিউজিক থেরাপি' ১৯৪৪ সাল থেকে প্রচলিত এবং তখন থেকেই মিচিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে এই বিষয়ে প্রথম স্নাতকস্তরের পড়াশুনা শুরু হয়। একইসঙ্গে কানসাস ইউনিভার্সিটিও শুরু করে মিউজিক থেরাপি নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি প্রােগ্রাম। ব্রিটেনে বিশ্বযুদ্ধের পর হাসপাতালে চিকিৎসারত সৈনিকদের সঙ্গীত শুনিয়ে সুস্থ করে তােলার প্রচেষ্টা হত। ব্রিটেনে ‘ক্লিনিকাল মিউজিক থেরাপির পথ প্রদর্শক ছিলেন ষাট এবং সত্তর দশকের বিশিষ্ট ফরাসী সেলিস্ট (Cellist) জুলিয়েট এ্যালভিন (Juliette Alvin) আবার মেরি প্রিস্টলী, যিনি ছিলেন জুলিয়েট এ্যাকিন-এর শিষ্য, সৃষ্টি করলেন ‘এ্যানালিটিকাল মিউজিক থেরাপি', যা বলে যে, যে কোনাে মানুষ যত অসুস্থই হােন না কেন, সঙ্গীতে সাড়া দিতে সক্ষম।

ভারতবর্ষে রাগসঙ্গীতকে নানাভাবে ব্যবহার করা হয়েছে মানুষের রােগনিরাময়ের জন্য। সঙ্গীতকে আমরা বলতে পারি শব্দ এবং ধ্বনির মাধ্যমে একধরণের যােগাসন যা আমাদের স্নায়ুতন্ত্রে প্রবেশ করে আমাদের আত্মার আত্মােপলব্ধিতে সাহায্য করে। রাগ বলতে আমরা কি বুঝি? রাগ বলতে আমরা বুঝি কিছু নির্দিষ্ট স্বরের সমষ্টি যার প্রয়ােগরীতি কখনাে মানুষের মনে আনে আনন্দ, কখনাে বা দুঃখ, কখনাে শান্তি, আবার কোনাে সময় ক্রোধ। রাগ গাওয়া, বাজানাে বা শােনা – এই তিন প্রকার দ্বারাই মানুষকে সুস্থ করে তােলা সম্ভব হতে পারে।

ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতকে আমরা দুই প্রকারে বিন্যাস করতে পারি : কল্পিত সঙ্গীত, যা পূর্বনির্ধারিত, নির্দিষ্ট চিন্তাপ্রসূত এবং সুবিন্যস্ত; এবং মনােধর্ম সঙ্গীত, যা তাৎক্ষণিকভাবে পরিবেশিত। প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থ “স্বরশাস্ত্র”-এর মতানুসারে ৭২টি মেলকর্তা রাগ আমাদের শরীরের ৭২টি বিশিষ্ট স্নায়ুতন্ত্রী কে চালনা করে। কেউ যদি রাগের লক্ষণ এবং শ্রুতি-শুদ্ধ অনুসারে রাগাভ্যাস করেন, তাহলে সেই রাগ আমাদের শরীরের সেই নির্দিষ্ট স্নায়ুতন্ত্রীকে সঠিকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। অবরােহীগামী স্বরগুলি আমাদের মনে একঅতঃখী ভাবেরসঞ্চার করে, আবার আরােহীগামী স্বরগুলি মনে আনে প্রফুল্লতা।

গবেষণার মাধ্যমে দেখা গেছে যে কিছু রাগ, যেমন দরবারী কানাড়া, খাম্বাজ এবং পুরিয়া আমাদের মনের অস্থিরতা বা টেনশন প্রশমিত করতে সাহায্য করে। হাইপারটেনশন’-এর রােগীদের জন্য আহীর ভৈরব, পুরিয়া এবং টৌড়ী অত্যন্ত উপকারী। ক্রোধ উপশমের জন্য দক্ষিণী রাগ যেমন পুন্নাগাভাৱলী, সাহানা প্রভৃতি ব্যবহৃত হয়। আমাদের পাকস্থলী সংক্রান্ত যা অসুখ হয়, তা সারানাে সম্ভব হয় দীপক রাগ দ্বারা (এ্যাসিডিটি), গুণকেলী এবং জৌনপুরী (কোষ্ঠকাঠিন্য) এবং মালকোষ (জ্বর) দ্বারা । রাগ মাড়বা ম্যালেরিয়া উপশমে সাহায্য করে এবং দরবারী কানাড়া, জয়জয়ন্তী ও সাহানা মাথাব্যথা কমবার জন্য ব্যবহৃত হয়। শােনা যায় পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ ঠাকুর একবার শ্রী রাগ শুনিয়ে এক ব্যক্তির একশ তিন ডিগ্রি জ্বর ও মাথাযন্ত্রণা নিরাময় করতে পেরেছিলেন। নিউ ইয়র্কের ‘ভিলেজ ভয়েস'' নামক একটি সাপ্তাহিকে প্রকাশিত হয়েছিল যে মানুষের শরীরের এমন কোনাে অসুখ নেই যা ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত সারাতে পারে না। কল্যাণের শুদ্ধ গান্ধার ব্লাড প্রেসার কমিয়ে দেয়, ভৈরাের কোমল রেখাব কিডনির অসুখ সারাতে সক্ষম। কেদারার দুই মধ্যম ঠিকমত লাগালে ইনসমনিয়া ঠিক হতে বাধ্য। সকাল বেলা এবং বিকেলে কোমল ও শুদ্ধ নিখাদ পর পর দশ মিনিট করে লাগালে করােনারি আর্টারি পরিষ্কার হয়ে যায়। এই প্রসঙ্গে একটি কথা এখানে বলা প্রয়ােজন যে, যেহেতু প্রত্যেক মানুষের কণ্ঠের একটি নিজস্ব পিচ' আছে, সেহেতু সেই “পিচ'অনুযায়ী একেকজনের ‘সা’ একেকরকম হয়। কাজেই কার সা’ কোন্ ‘পিচ’-এ, এটি সঠিকভাবে নির্ধারিত না হলে চিকিৎসা করা মুস্কিল হয়ে পড়ে। এই সা’ নির্ধারণের জন্য এক জাপানি ব্যক্তি, যিনি পণ্ডিত প্রাণনাথের শিষ্য, স্টেথিসকোপের মত দেখতে একটি ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন। এটি রােগীর নাভিকুণ্ডলের ওপর রেখে তাকে মুখ বন্ধ করে গুনগুন করতে বলা হয়। ট্রায়াল অ্যাণ্ড এরর মেথডে দুই-তিন মাসে তার সঠিক ‘পিচ’ এবং ষড়জ নির্ধারিত করা যায়।

শুধু মার্গ সঙ্গীত কেন, রবীন্দ্রসঙ্গীতও যে মানুষের মন এবং শরীরের ওপর কতটা কাজ করে তার উদাহরণ এখন ক্রমবর্ধমান। কয়েক বছর আগে শহরের একটি প্রথমসারির দৈনিক পত্রিকায় একটি সংবাদ শিরােনাম সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে “গানে অসুখ সারে, মানছেন দেশবিদেশের ডাক্তাররা”। তাতে প্রকাশিত হয়েছে জার্মানির বন শহরের একটি কিশাের মাক্স স্কুল শেষ হতে না হতেই মানসিক অবসাদের শিকার হয়ে পড়ে। বাড়ীর কাছেই টেগাের ইনস্টিটিউটে গিয়ে সে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখতে শুরু করল। ধীরে ধীরে তার মানসিক পরিবর্তন হতে আরম্ভ করল এবং আজ সে সম্পূর্ণ সুস্থ জীবন ফিরে পেয়েছে, ফিরে পেয়েছে জীবনের প্রতি, বেঁচে থাকার প্রতি আগ্রহ। 

মনােরােগ বিশেষজ্ঞ ধীরেন্দ্রনাথ নন্দীর মতে,

“মানবদেহের প্রত্যেকটি ক্রিয়াকলাপের মধ্যে একটা ছন্দ বা রিদম’ রয়েছে। সাধারণত দেখা যায়, মানসিক রােগীর ক্ষেত্রে সেই ছন্দ হারিয়ে গেছে। ফলে তার ব্যক্তিত্বে সাযুজ্যের অভাব ধরা পড়ে। সঙ্গীত এই সাযুজ্য ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।” 

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনােবিজ্ঞান বিভাগের রিডার ও সাইকো থেরাপিস্ট ডঃ নীলাঞ্জনা সান্যালের মতে, ‘সঙ্গীতের ফলে রােগীর অবরুদ্ধ আবেগের প্রকাশ ঘটে, ডাক্তারি ভাষায় যাকে বলে মেন্টাল ক্যাথারসিস। গান শুনতে শুনতে অতিরিক্ত উদ্বেগ বা ভয় থেকে ধীরে ধীরেমন মুক্ত হয়, মানসিক ভারসাম্য ফিরে আসে।” 

কলকাতার তারাতলার স্প্যাস্টিক সােসাইটি অব ইস্টার্ন ইণ্ডিয়াতে সঙ্গীতের এই বিশেষ ক্ষমতাকে পূর্ণ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সেখানে প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়মিত গান শােনানাে এবং শেখানাে হয়। সংস্থার সহ অধ্যক্ষ জানালেন, গানের মধ্য দিয়ে সংখ্যা আর অক্ষর শেখাতে গিয়ে তারা আশাতীত ফল পেয়েছেন। প্রতিবন্ধী শিশুরা গান গেয়ে শিখতে বেশী মজা পায়, ফলে শেখানাের কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। সম্প্রতি বিভিন্ন জেলগুলিতেও কয়েদীদের জন্য সঙ্গীতচর্চার বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে, | যার মধ্য দিয়ে তাদের মানসিক পরিবর্তন হচ্ছে কিনা এবং হলে, তা কতটা, তা লক্ষ্য করা হবে। | 

সম্প্রতি বিশিষ্ট তবলিয়া শ্ৰী তন্ময় বসু মহাশয় বাংলার ঢাকী শিল্পকে লােকসমক্ষে নিয়ে আসতে সচেষ্ট হয়েছেন। তার একনিষ্ঠ প্রয়াসে বাংলার ঢাকবাদ্য, যা ক্রমশ অবলুপ্তির পথে চলে গিয়েছিল, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আজ তা পরিবেশিত হচ্ছে। কলকাতার ’স্বভূমি’-তে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের পঞ্চাশজন ঢাকীকে নিয়ে সম্প্রতি তিনি একটি কর্মশালা এবং শেষে একটি মনােজ্ঞ অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেন। সেই অনুষ্ঠানে ঢাকের সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীত, ঢাকের সঙ্গে নজরুলগীতি, ঢাকের সঙ্গে কথক নৃত্য, ছৌ নৃত্য, ঢাকের সঙ্গে সানাই এবং বাউল গান শুনে বার বার মনে হচ্ছিল যে এই সম্মিলিত সুর মানুষের মনকে এক অন্য স্তরে নিয়ে যেতে সক্ষম, যা তার সকল মানসিক অবসাদ এবং শারীরিক ক্লান্তি ও যন্ত্রণা উপশমে ভীষণভাবে কার্যকরী হবে।

সুতরাং পরিশেষে বলা যায়, যে সুর বা সঙ্গীত, তা সে যেকোনাে প্রকারেরই হােক না কেন, ’গীত, বাদ্য ও ছন্দ’ থাকলে, মানুষের মনকে নাড়া দিতে বাধ্য এবং এর প্রয়ােগ কেবল আমােদ প্রমােদের উপকরণ হিসেবে নয়, সার্থকভাবে চিকিৎসাক্ষেত্রে প্রয়ােগ করে মানুষের অনেক কল্যাণের কাজে নিযুক্ত হতে পারে।


এই আলেখ্যটি শোনার জন্য নীচের Link টি click করুন -





ড: শমীতা মুখোপাধ্যায়



রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত বিভাগের(দূরশিক্ষা) অধ্যাপিকা। আকাশবাণী কলকাতা র রবীন্দ্রসঙ্গীত এ 'বি হাই' এবং কান্তগীতি,  অতুলপ্রসাদী ও দ্বিজেন্দ্রগীতি তে 'এ' গ্রেড শিল্পী,  দূরদর্শন  ও কলকাতার বিভিন্ন মঞ্চে র নিয়মিত শিল্পী। গীতবিতান শিক্ষায়তন এর  'গীতভারতী' উপাধি র স্বর্ণ পদক প্রাপ্তা,  রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় রবীন্দ্রসঙ্গীত বিভাগের স্বর্ণ পদক প্রাপ্তা। গবেষণার বিষয় মিউজিক থেরাপি।সংগীত গুরু বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষক শ্রীমতি মায়া সেন। এছাড়া, শ্রীমতী কনক বিশ্বাস,  শ্রীমতী গীতা সেন, শ্রী নীহারবিন্দু সেন, শ্রীমতী পূর্বা দাম ও শ্রীমতী পূরবী মুখোপাধ্যায়ের স্নেহধন্যা। 'দেবব্রত বিশ্বাস স্মৃতি পুরস্কার' এ সম্মানিত হন।




Comments

Popular Posts