পুজোর গান : গোড়ার কথা
শ্রীস্বপন সোম
শরতে আজ কোন অতিথি এল প্রাণের দ্বারে l শারদোৎসব l বাঙালির প্রাণের উৎসব l আর শারদোৎসব মানেই শিউলি ফুল, সুনীল আকাশ, মহালয়ার ভোরে রেডিওতে মহিষাসুরমর্দিনী l আর এই পুজোর সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে পুজোর গান l যদিও তার রূপ - রস - গন্ধ এখন অনেক ফিকে হয়ে এসেছে l
1907 সালে গ্রামোফোন কোম্পানি রেকর্ড ছাপাতে শুরু করে, তারপর প্রতিমাসে নানা রেকর্ড বেরোতে থাকে l এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে যে প্রথম 1914 সালে সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত রেকর্ড সম্পর্কে বিজ্ঞাপন দেওয়া হল -- ' শারদীয়া পুজা উপলক্ষে l ' তারপর লেখা -- ' সেপ্টেম্বর 1914 নতুন 10 ইঞ্চি, ডবল সাইডেড ভায়োলেট ( ধূমলবর্ণ ) লেবেলযুক্ত বাংলা গ্রামাফোন রেকর্ড l' তখন আগমনী - বিজয়ার গানের খুব প্রাধান্য ছিল l সেবার কে মল্লিক শোনালেন আগমনী -- ' গিরি একি তব বিবেচনা ' ও বিজয়া - ' কী হবে কী হবে উমা চলে যাবে l' এই কে মল্লিকের আসল নাম মহম্মদ কাশেম l বর্ধমান থেকে কলকাতা আসেন গানের টানে l এখানে গোরাচাঁদ মল্লিক নামে একজন তাঁকে রেকর্ড করতে খুব সাহায্য করেন l তখন কাশেমের কে আর গোরাচাঁদের মল্লিক জুড়ে তাঁর নাম হল কে মল্লিক l ভক্তিগীতিরও প্রাধান্য ছিল তখন l ব্ল্যাক লেবেল রেকর্ডে সেবার অর্থাৎ 1914 তে নর্তকী - গায়িকা কৃষ্ণভামিনী গাইলেন ' মাকে কে জানে ' ( মালকোষ ) ও ' অলসে অবশে বল '( পূরবী ) l গানের শেষে তিনি বলতেন -- ' মাই নেম ইজ কেষ্টভামিনী ' l এক একজনের আবার দুটি করে রেকর্ডও বেরোত l যেমন বেদানা দাসী l একটিতে গাইলেন জন্মাষ্টমীর গান, অন্যটিতে নৃত্য - সম্বলিত জংলা গান ' গয়লা দিদি লো ' এবং ' আমি এসেছি এসেছি বঁধু হে ' l সেসময় ভদ্রঘরের মেয়েরা রেকর্ডে খুব একটা গান গাইতেন না l সম্ভ্রান্ত বংশের প্রথম মহিলা যিনি রেকর্ডে গেয়ে নাম করেছিলেন তিনি হলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বোন অমলা দাশ l ঠাকুরপরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অমলা সংগীতজগতে মিস দাস ( এমেচার ) নামে পরিচিত ছিলেন l 1914-র পুজোয় তিনি গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের ' হে মোর দেবতা ' ও ' প্রতিদিন আমি হে জীবনস্বামী 'l তখন কমিক বা হাসির গানেরও একটা ধারা যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল l 1914-র পুজোয় অভয়াপদ চট্টোপাধ্যায় এক হাসির গানের রেকর্ডে শুনিয়েছিলেন ' স্ত্রীর প্রতি স্বামীর আদর ' ও ' স্বামীর প্রতি স্ত্রীর আদর ' l
বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক, তৃতীয় দশকের শুরু পর্যন্ত সময়সীমায় আমরা আরও কিছু স্মরণীয় শিল্পীকে পেলাম যাঁরা পুজোর গান গেয়েছেন l যেমন - আশ্চর্যময়ী দাসী, এম এন ঘোষ ( মন্তাবাবু ), আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, কৃষ্ণচন্দ্র দে, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, কমলা ঝরিয়া, ধীরেন্দ্রনাথ দাস প্রমুখ l নানা ধরণের গানে পারদর্শী কৃষ্ণচন্দ্র দে 1917-র পুজোয় গাইলেন আগমনী - ' আর চলে না চলে না মাগো ' ও ' মা তোর মুখ দেখে কি ' l তাঁর অন্যান্য পুজোর গান -- 1935 এ ' সখি লোকে বলে কালো ', 1939এ ' স্বপন দেখিছে গিরিরানী ' l 1923 -র পুজোয় ইন্দুবালা শোনালেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের লেখা বিখ্যাত গান -- ' ওরে মাঝি তরী হেথায় বাঁধবো না কো ' l আঙ্গুরবালা সাধারণত প্রেমের গান গেয়েই অভ্যস্ত, 1922- র পুজোয় গাইলেন ভক্তিগীতি - 'কত আশা করে তোমারি দুয়ারে ' ও ' আমার আমায় বলিতে কে ' l কমলা ঝরিয়ার প্রথম রেকর্ড পুজোতেই l 1930-এ গাইলেন গজল ' প্রিয় যেন প্রেম ভুলো না 'ও দাদরা ' নিঠুর নয়নবান কেন হানো ' l হীরেন বসুর দুটি রচনা - ' আজি শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও ' বা ' আজ আগমনীর আবাহনে ' এখনো শারদোৎসবের নানা বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত হয় l গান দুটি গেয়েছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দাস l অবশ্য পুজো নয়, বেরিয়েছিল 1931-র ডিসেম্বর মাসে l দেশ পরাধীন, স্বাধীনতা সংগ্রাম চলছে l লেখা হচ্ছে দেশান্তবোধক গান l দেশাত্ববোধক গানের রেকর্ডও বেরোত l 1922- এ ক্ষেত্রমোহন মিত্র ও সহশিল্পীবৃন্দ গাইলেন ' সেকালের বাংলা ও চরকার গান ' l হরেন্দ্রনাথ দত্ত শোনালেন বঙ্কিমচন্দ্রের ' বন্দেমাতরম ' ও রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী গান 'দেশ দেশ নন্দিত করি ' l এই হরেন্দ্রনাথই 1925- র পুজোয় গেয়েছিলেন কাজী নজরুলের বিখ্যাত ' জাতের নামে বজ্জাতি সব ' -- এটা সম্ভবতঃ রেকর্ডে প্রথম নজরুলের গান l
1925-র পুজোতেই আরেকটি উল্লেখযোগ্য রেকর্ডে দ্বিজেন্দ্রলাল পুত্র দিলীপ কুমার রায় গাইলেন সুপরিচিত গান - ' মুঠো মুঠো রাঙাজবা কে দিল তোর পায়ে ' l দিলীপ কুমার ' ধনধান্য পুস্পভরা ' গেয়েছিলেন 1938-র পুজোয় l দিলীপকুমার - শিষ্যা অকালপ্রয়াত উমা বসু 1939-র অক্টোবরে গেয়েছিলেন দিলীপকুমারেরই গান -' জীবনমরণে এসো 'l
বাংলায় প্রথম গজল লিখেছিলেন অতুলপ্রসাদ সেন --' কত গান তো হল গাওয়া '-- সাহানা দেবী এটি শোনালেন 1925-র পুজোয় l রবীন্দ্র - পরিমণ্ডলের আরেক শিল্পী কনক দাস পুজোয় রবীন্দ্রসংগীত, অতুলপ্রসাদের গান দুইই গেয়েছেন l যেমন 1932-র পুজোয় তিনি রেকর্ড করলেন অতুলপ্রসাদী -- 'তব চরণতলে সদা রাখিও ' l 1936-র পুজোয় রবীন্দ্রনাথের ' সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে ' l
সেসময় থিয়েটারের গানও খুব জনপ্রিয় ছিল l তা রেকর্ডে প্রকাশিতও হত l 1915 তে 6 টি রেকর্ডে বেরোল পালাগান -- অন্নদামঙ্গল l 1916-র পুজোয় প্রকাশিত হল গিরিশচন্দ্র ঘোষের গীতিনাট্য -- আবু হোসেন l 1927-র পুজোয় পাওয়া গেল ' কর্ণার্জুন ' নাটকে অহীন্দ্র চৌধুরীর স্মরণীয় অভিনয় l
এই হল পুজোর গানের প্রথম দিককার কিছু কথা l
এই আলেখ্যটি শোনার জন্য নীচের Link টি click করুন -




অপূর্ব একটি লেখা । অজানা তথ্যে সমৃদ্ধ । খুব ভালো লাগল
ReplyDelete