আধ্যাত্মিকতায় সঙ্গীতের প্রভাব

শ্রীঅভিজিত গোস্বামী

অধ্যাত্মবাদ বা spiritualismশব্দটির আভিধানিক অর্থ থেকে আমরা ঠিক ততটুকুই বুঝি যতটুকু সমূদ্রের এক আঁজলা জল থেকে সমূদ্রকে বোঝা যায় । শব্দ ব্রহ্ম একথা মাথায় রেখেই বলতে বাধ্য হচ্ছি যে তথাকথিত অধ্যাত্মতত্ত্ববিদ ,one who has. Knowledge about God or the Soul, এই শব্দটির আভিধানিক অর্থ থেকে একশ্রেণির পণ্ডিতগণকে বোঝান হয় যাঁরা ঈশ্বর তথা আত্মঅন্বেষণের সম্পর্কে বিশদ ঞ্জান লাভ করেছেন । উপমার পুনরাবৃত্তি না করে এক্ষেত্রেও বলতে বাধ্য হচ্ছি যে এথেকেও কিছুই বোঝা যায়না , কারণ আত্ম-অন্বেষণের গভীর থেকে গভীরতর মনোরাজ্যে যাঁরা প্রবেশ করেন ধ্যানমগ্নতায় লীন হয়ে এবং যাঁরা প্রকৃত সেই ঞ্জান লাভ করেন তাঁরা তা ব্যাখ্যা করার জন্য পার্থিব মায়ার জগতে আর ফিরে আসতে পারেন না ( বিরল ব্যতিক্রম বাদে) । কথামৃত তে শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের মুখ-নিসৃত অমৃত বাণীর সাহায্য নিয়ে বলি যে নুনের পুতুল সমূদ্রের গভীরতা মাপতে গেলে আর ফিরে এসে সে খবর জানাতে পারেনা । ফলে অধ্যাত্মবাদ বলতে ঠিক কি বোঝায় আর কতটাই বা তার ব্যপ্তি তা সম্পূর্ণ উপলব্ধির ব্যাপার যেটাকে ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব অনেকটা বালতি করে সমূদ্রের জল নিঃশেষ করার প্রচেষ্টার মতন-ই ।

ঠিক এখানেই সঙ্গীতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । চিত্রকর যেমন তাঁর একটি চিত্রের মাধ্যমেই সহস্র সহস্র শব্দ দ্বারা প্রকাশ করতে হয় এমন ভাবনাকেও তুলে ধরতে পারেন দেশ-কাল-পাত্র নির্বিশেষে ঠিক তেমনি একটি সঠিক সঙ্গীতের মাধ্যমেও মুমুক্ষু সাধারন মানুষও নিরাকার নির্গুণ ঈশ্বরের কাছে পৌঁছনোর মার্গ এর সন্ধান পেতে পারেন, যে মার্গের সন্ধানে যুগে যুগে মুমুক্ষু জীব সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীতে পরিণত হয়েছেন । এই মার্গ সন্ধানের বিভিন্ন পথের মধ্যে ভক্তি- প্রেম রসপূর্ণ সঙ্গীতের আশ্রয় গ্রহণ খুবই কার্যকরী একটি উপায় যেখানে সংসারে থেকেও মুমুক্ষু মানুষ তাঁর কাছে পৌঁছতে পারে কোন তথাকথিত কঠিন সাধনা ছাড়াই;  উদাহরণ হিসেবে সাধক রামপ্রসাদ,কমলাকান্ত স্বামী বিবেকানন্দ এমন প্রচুর নাম করা যায় এমনকি স্বয়ং রামকৃষ্ণ দেবও শুধু সুকন্ঠ গায়কই ছিলেননা তিনি কথামৃতে উল্লেখও করেছেন , " যে গাইতে, বাজাতে , ......যে কোন একটা গুণের অধিকারী  তার কাছে ঈশ্বর লাভ সহজ" এর অর্থ অবশ্যই এটা নয় যে গুণগুলো থাকলেই অধ্যাত্ম চিন্তার বিকাশ ঘটবে , বরং এটাই হয়ত তিনি বলতে চেয়েছেন যে ঈশ্বরলাভে ইচ্ছুক তথা আত্মান্বেষী মানুষ এই গুণ গুলোর যেকোন একটার অধিকারী হলে তার পক্ষে আধ্যাত্মিকতার সুবিশাল অসীম সাম্রাজ্যে প্রবেশ করা সহজ হয় । মনে রাখতে হবে কথামৃতে স্থানান্তরে শ্রী রামকৃষ্ণ দেবই আবার বলেছেন যে পরম জ্ঞান তথা আত্মস্বরূপ একবার কোন ব্যক্তির কাছে উন্মোচিত হলে তিনি আর সংসারের মায়াজালে আবদ্ধ থাকতে পারেন না ...এমনকি খণ্ডমুহূর্তের জন্যও প্রকৃত ব্রহ্মজ্ঞানীর পক্ষে মনকে সংসারের নীম্নস্তরে নামিয়ে আনা অসম্ভব..।

অবশ্যই বিরল ব্যতিক্রম কেউ কেউ আছেন যাঁরা সেই উচ্চস্তরে পৌঁছেও লোকশিক্ষার জন্য নীম্নস্তরে মনকে সংসারের মায়ায় ফিরিয়ে আনতে পারেন ... স্বয়ং শ্রী রামকৃষ্ণ ছিলেন বিরলের মধ্যে বিরলতম সেই উচ্চকোটির এক সাধক যিনি স্বয়ং শিষ্যদের /ভক্তদের/অনুরাগী দের সামনে স্বীকার করতেন যে এভাবে তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার জন্য তাঁকে  " দু থাক " নেমে আসতে হয় । এহেন শ্রী রামকৃষ্ণ দেবও ছোট থেকেই ছিলেন সুকন্ঠের অধিকারী গায়ক এবং পরবর্তীতে শিষ্য-পরিবৃত ঠাকুর কে বহুবার "নরেন" এর (পরবর্তীতে যিনি স্বামী বিবেকানন্দ রূপে জগৎবিখ্যাত হয়েছিলেন) বা অন্য বিশেষ বিশেষ গান শুনে ( কেশবচন্দ্র সেনের বাড়িতে ব্রাক্ষ্ম সঙ্গীত , গিরিশ ঘোষের থিয়েটার এ কোন গান ... ইত্যাদি) সমাধিস্থ হয়ে পড়তেন এবং মনজগতের সেই উচ্চকোটির স্থানে পৌঁছে যেতেন যেখানে পৌঁছনো বহু সাধকের সারাজীবনের সাধনাতেও সবসময় সম্ভব হতোনা । 

নরেনের মুখে " জুড়াইতে চাই কোথায় জুড়াই ...."," আমার মা তন্বী তারা ...",  "রামপ্রসাদী গান,". ..."  "হরিনামগান" প্রভৃতি  শ্যামাসঙ্গীত অথবা ভক্তিগীতি  ঠাকুর শুনতে বিশেষ ভালোবাসতেন ।

ঠাকুরের কথা থাক তিনি বিরলের মধ্যে বিরলতম ... আসুন আমরা পরীক্ষা করি সাধারন মানুষদের নিয়ে , আমি / আপনি কখনো না কখনও এমন অভিজ্ঞতার সামনে নিশ্চয়ই পরেছি যেখানে কোন সঙ্গীত আমাদের স্তব্ধ করেছে,নির্বাক করেছে , মুগ্ধতার ভাষাহীন প্রকাশ ঘটেছে চক্ষুনিসৃত পান্নার প্লাবনে । আজ্ঞে হ্যাঁ এটাই সেই অধ্যাত্মবাদের রহস্যময় সাম্রাজ্যে প্রবেশের প্রথম সোপান ..... 

সঠিক গীতিকার - সুরকার- গায়ক/গায়িকা - বাদ্যযন্ত্রের মূর্ছনা এবং অবশ্যই শ্রোতার (হ্যাঁ ঠিকই পড়েছেন শ্রোতারও ভূমিকা অপরিসীম সম্ভবত সর্বাধিক) , মেলবন্দ্ধনে আধ্যাত্মচিন্তার বিকাশ ঘটে এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে জাত শ্রোতার মানসে নিরাকার নির্গুণ ব্রহ্মকে উপলব্ধির ইঙ্গিত দেয় । সাধক তাঁর সাধনার বলে নিরাকার - নির্গুন ঈশ্বরের সাকার রূপের (আপন আপন ধর্ম সংস্কার অনুযায়ী ) সাক্ষাৎ পেলেও পেতে পারেন যথা কালী - কৃষ্ণ - শিব- মহম্মদ- খ্রীষ্ট অথবা আদিবাসীদের মারাংবুরু প্রভৃতি অসংখ্য  রূপে সেই একই নির্গুণ -নিরাকার ঈশ্বর তথা পরম ব্রহ্ম মায়াবদ্ধ সাকার রূপে সাধকের সাধনপথ অনুযায়ী দর্শন দিয়ে তাঁদের ধন্য করেন কিন্তু নিরাকার, নির্গুণ মায়াবদ্ধতার অতীত পরমেশ্বর তথা পরম ব্রহ্ম অধরাই থেকে যান (তৈলঙ্গস্বামী, শ্রী রামকৃষ্ণ প্রভৃতি গুটিকতক মহাপুরুষ ছাড়া)। 

সঙ্গীত কিন্তু অতি সহজেই সাকার মায়াবদ্ধ ঈশ্বর ও নিরাকার- নির্গুণ ঈশ্বর এই দুয়ের সাথেই সাধকের মিলন ঘটান গভীরতর উপলব্ধির পথ দিয়ে । সঙ্গীতে এমনকি সেই ক্ষমতাও রয়েছে যার মাধ্যমে একজন অতিসাধারন সংসারী কিন্তু মুমুক্ষু মানুষ গভীর চৈতন্যে লীন হয়ে যেতে পারেন , নিছকই একজন শ্রোতার উপলব্ধিতে অধরা ধরা দেন শ্রোতার ই দেহভাণ্ডে ।

           বাউলসঙ্গীতের একটি প্রচলিত গান আছে ...." তোমার ঘরে বাস করে মন কয়জনা ও জান না ,তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা ..."  আবার রবীন্দ্রনাথের লেখা পুজা পর্যায়ের বিখ্যাত গান.... "আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি তোমায় দেখতে আমি পাইনি ...." আপন উপলব্ধির চরম সীমায় পৌঁছতে না পারলে অখ্যাত বাউল শিল্পী ও সুবিখ্যাত কবিগুরু তাঁদের অমর সৃষ্টিতে এভাবে মিলে মিশে একাকার হয়ে যেতে পারতেন না । আধ্যাত্মচিন্তার চরম ও পরম লক্ষ্য এভাবেই সত্যান্বেষী তথা আত্মান্বেষী । আমাদের অনেকের কাছেই অজানা অচেনা কোন বাউল রচণা করে গেছেন ......

""আমার ঘরের চাবি পরের হাতে 

কেমনে খুলি সে ধন দেখি চক্ষেতে

আপন ঘরে বোঝাই সোনা 

(হায়রে) পরে করে লেনাদেনা 

(আর)আমি হলেম জমমো কানা

না পাই দেখিতে .....""

কোথাও মিল পাচ্ছেন ? বিশ্বাস করুন বিখ্যাত কবিগুরু আর ঐ গানের রচয়িতা অখ্যাত  বাউল কেউই একে অপরের সঙ্গে মেশার সুযোগই পাননি ,ভাবাদর্শ বিনিময় তো অনেক দুরের কথা । তবু এঁরা মিশে গেছেন একাকার হয়ে গেছেন আত্মান্বেষনের তথা আধ্যাত্মচিন্তার রাস্তায় একই উপলব্ধিতে । 

পথের বাউল গাইছেন ............

" ওহে দীন দরদী বলোনা কেন !

তুমি যদি মন্দিরেতে করো অবস্থানো

তবে এজগৎ সোমসার কার নিকেতনো

কেউ বলে তুমি রাম থাক পুবে আর পশ্চিমে আলি।

তবে কেন হিদয় সুরে খালি ! ওহে দীনদরদী---

কেউ জানেনা , তুমি মনের মানুষ মনে অবস্থানো ।।

রবীন্দ্রনাথের ভাষায় 

""........ কাজ কি আমার মন্দিরেতে আনাগোনায়

পাতব আসন আপন মনের একটি কোণায়

সরল প্রাণে নীরব হয়ে তোমায় ডাকি 

তোমার পুজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি ....""

বাউল তত্ত্বের ঈশ্বর সাধনার অপূর্ব ব্যাখ্যা স্বয়ং কবিগুরু র মনকেও নাড়া দিয়েছিল তাই তাঁর অনেক সৃষ্টিতেই বাউল গানের প্রভাব দেখা যায় । সংসারী হয়েও রবীন্দ্রনাথও যে একজন আত্মান্বেষী মহাপুরুষ ছিলেন, তিনিও যে অন্তরেতে বাউল ছিলেন, তিনিও যে সেই অধরাকেই ধরতে চেয়েছিলেন ।তাইতো তিনি অনুভব করেছিলেন

 " আনন্দধারা বহিছে ভুবনে ” ; 

আপন উপলব্ধিতে পেয়েছিলেন 

 " ... ...অন্তরগ্লানি সংসারভার পলক ফেলিতে কোথা একাকার ।

জীবনের মাঝে স্বরূপ তোমার রাখিবারে যদি পাই ।।"

 

           চলে আসি সাধক রামপ্রসাদ,কমলাকান্ত,শ্রী রামদুলাল এঁদের কথায় ।এঁদের গানের কলির ছত্রেছত্রে সাকার ঈশ্বর তত্ত্বের অপূর্ব আকুতি। বলা শক্ত যে এঁরা সাধক ছিলেন বলেই ঐ ধরনের সঙ্গীত সৃষ্টি করেছিলেন নাকি এই ধরনের সঙ্গীত রচনা করতে করতেই আধ্যাত্মচিন্তার রাস্তায় পৌঁছতে পেরেছিলেন ! সঙ্গীত আধ্যাত্মিকতাকে প্রভাবিত করেছিল নাকি আধ্যাত্মিকতা সঙ্গীত কে ?

এর মীমাংসা পাঠক/পাঠিকার উপর ছেড়ে দেওয়াই সমীচিন হবে । শুধু এটুকু পাঠক/পাঠিকাকে স্মরণে রাখতে অনুরোধ করব যে যাঁর প্রাণে একাধারে সৃষ্টি রহস্য তথা নিজেকে জানার আগ্রহ ও শিল্পী সত্ত্বা দুই-ই থাকে তাঁদের সঙ্গীতেই আমরা আধ্যাত্মিকতা খুঁজে পাই ,সে রামপ্রসাদই হোক বা কমলাকান্ত ,রবীন্দ্রনাথই হোক বা অনামা অচেনা কোন বাউল ।

পরিশেষে একটা কথা বলি শব্দসংখ্যার সসীম গণ্ডিতে এই আলোচনায় অসীমকে ধরতে চেষ্টা করেছি যা কার্যত অসম্ভব ।শেষকরি এটা লিখে যে অনেক সময়েই সৃষ্টি যিনি করেন আর যিনি তা শ্রবন (বা গ্রহন ) করেন দুজনের চিন্তাধারা মেলেনা আর এটাই কবিতার মতো সঙ্গীতেরও সার্থকতা যা অতি সাধারন মানুষকেও অসাধারন অধ্যাত্ম অনুভূতি এনে দিতে পারে ।

জিজ্ঞাসাটা রয়েই গেল !!   " সঙ্গীতে আধ্যাত্মিকতার প্রভাব !!" নাকি "আধ্যাত্মিকতায় সঙ্গীতের প্রভাব!! " বিচারের ভার আপনাদের  ।

অভিজিত গোস্বামী



জন্ম- 1974, St. Johns, Hooghly Branch Govt High School, RKMS Belur Moth থেকে যথাক্রমে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, DME পাশ  ......... 2008 এ প্রথম কবিতার বই প্রকাশ ' ক্যাকটাসের জন্য । ছোটবেলা থেকেই যোগা প্রাণায়াম সঙ্গীত, কবিতা  ও আধ্যাত্মিক  'জগতের প্রতি আকর্ষণ । বর্তমানে আত্ম অন্বেষণে মগ্ন ।



Comments

Popular Posts