রবীন্দ্রনাথের নূতন নাতনি
ডা: গার্গী দাস বক্সী
বরানগরের লাহিড়ী পরিবার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সাথে যোগাযোগ ছিল । সেই পরিবারের কন্যা পারুল দেবী রবীন্দ্রনাথের নূতন নাৎনী । মহেশচন্দ্র লাহিড়ী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বন্ধু স্থানীয় । তার পুত্র শরৎচন্দ্র পেশায় ছিলেন আইনজীবী । রবীন্দ্রনাথ তাকে বন্ধুপুত্র হিসেবে স্নেহ করতেন । ৯ নম্বর কালিদাস লাহিড়ী লেন, বরানগর ছিল লাহিড়ী পরিবারের বাস । কবি গিয়েওছেন সেখানে।
রবীন্দ্রনাথের নতুন নাতনি পারুল দেবী । ১৯১৫ সালে জন্ম । সাহস করে ছোট বোন আর দুই ভাইকে নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন বরানগরের 'শশী ভিলা'য় । পারুল দেবীর 'রানী দিদি'র বাড়িতে । প্রশান্তচন্দ্র ও রানী মহলানবীশের সুবিস্তৃত বাগানবাড়ি শশী ভিলা ছিল কোভিদ খুব প্রিয় জায়গা । প্রথমত বরানগর ছিল সেই সময়ে প্রায় একটি গ্রাম এবং মহলানবীশ দম্পতি ছিলেন কবির খুব কাছের মানুষ । কলকাতার জোড়াসাঁকোর পরিবেশ তার একেবারেই প্রিয় ছিল না, এই কথা তিনি বার বার নানা লেখায় আলোচনায় বলেছেন।
কবির সাথে পারুল দেবীর খুব সুন্দর সম্পর্ক হয়েছিল । ভোজনরসিক রসিক রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন এক সুরন্ধন পটীয়সী নাতনিকে । পারুল দেবীর লঙ্কা ও মশলা বর্জিত রান্নার দারুণ ভক্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ । প্রথম আলাপেই কবি জিজ্ঞাসা করেছিলেন,
"কি গো তুমি কিছু রাত সে পারো নাকি?" উত্তরে পারুল দেবী বলেছিলেন, "বাংলাদেশের মেয়ে একটু আধটু রাতে জানি বইকি।" সেই শুরু । পারুল দেবী ও তার ছোট ভাই এই দুই ভাইবোনকে কবি প্রায় ৬৪টি চিঠি লেখেন । বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনে চিঠি গুলি সংরক্ষিত আছে ।
রবীন্দ্রনাথকে যেসব রমণীরা কাছ থেকে দেখেছেন, জানার সৌভাগ্য হয়েছে, কবির স্নেহ ভালোবাসা পেয়েছেন তাদের মধ্যে পারুল দেবীও একজন । কিন্তু তার সম্পর্কে খুব বেশি চর্চা হয়নি । প্রচারবিমুখ পারুল দেবী সম্পর্কে জানা যায় তার মৃত্যুর পর তার স্বামীর কাছ থেকে । প্রথম চিঠি পত্রের আদান প্রদান শুরু হয় ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৪ সালে । কবি তখন শান্তিনিকেতনে । ১৯২৯ সালে শ্রীদীনেশচন্দ্র রায়ের সাথে পারুল দেবীর বিয়ে হয় ।বিয়ের পর তার স্বামীর বেশ কিছু দিন স্থায়ী চাকরি ছিল না । ফলে নিদারুণ অর্থকষ্টে তার দিন কাটে । আর সেই সময় পারুল দেবীর একটি কন্যা সন্তান হয় । কিন্তু মাত্র সাত মাস বয়সে এক শীতের রাতে সে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে বিদায় নেয় । পারুল দেবীর ব্যক্তিগত জীবনের এই নিদারুণ বিপর্যয়ের দিনে কবির স্নেহ, তার লিখিত চিঠি পারুল দেবীর জীবনে ছিল দেবতার আশীর্বাদ, ঈশ্বরের স্পর্শ । আসলে সাংসারিক কারণে স্বামীর আর্থিক অসঙ্গতি, ছোট শিশুকে হারানোর বেদনা, সব মিলিয়ে পারুল দেবী এতটাই শোকসন্তপ্ত হয়ে পড়েন, তখন তার পিতা শরৎচন্দ্র তাঁর নিজের কাছে কন্যাকে এনে রাখেন । প্রায় টানা দশ বছর ছিলেন পিতৃগৃহে ।
পরবর্তী সময়ে তিনি স্বামীর কাছে যান । দীনেশচন্দ্র রায় জীবন বীমা কোম্পানিতে চাকরি পান । উচ্চপদস্থ কর্মচারী হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন । নিঃসন্তান দম্পতি ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত কল্যাণীতে ছিলেন । ওই বছরই ১১ই মার্চ ৫৬ বছর বয়সে পারুল দেবী পরলোকগমন করেন । স্ত্রীর মৃত্যুর পরে দীনেশচন্দ্র কল্যাণীর বাস উঠিয়ে চন্দননগরে চলে যান । ১৯৮৬ সালের প্রথম দিকে তার মৃত্যু হয় । স্ত্রীর মৃত্যুর তিন মাস পরে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক কুনাল সিংহ মহাশয় এর আন্তরিক আগ্রহে পারুল দেবীর স্বামী পত্রগুলি প্রকাশ করেন ।
কবি তার দৌহিত্রী শ্রীমতি নন্দিতাকে কোন এক পুজোর ছুটির সময় লিখেছিলেন,
ছুটি চলেচে, ছাত্রীরা বেণী দুলিয়ে অটোগ্রাফ নিতে আসে না - বিদেশি ডাক এলে স্ট্যাম্পের কাঙালরাও ভিড় করে না । ইতিমধ্যে দিন কয়েকের জন্য পারুল আর তার ছোট বোন এসেছিল । তারা আমার বরানগরবাসীনি নূতন নাৎনি । তারা বুড়ি নয়, সেই জন্য নূতন আগ্রহের সঙ্গে সেবাযত্ন করে ।
১৯৩৪ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে রচিত অনেকগুলি গ্রন্থ কবি পারুল দেবী কে উপহার দিয়েছিলেন । পারুলদেবী কে লেখা পত্রাবলীকে কালানুক্রমিক ভাবে সাজালে কবি তিনটি সম্পূর্ণ কবিতা লিখেছিলেন । তার মধ্যে দুটি প্রকাশিত হয়েছিল বিশ্বভারতী পত্রিকায় আর একটি কোন্ পত্রিকায় তা জানা যায়নি । কালানুক্রমিক ভাবে সাজালে প্রথম কবিতাটি 'প্রহাসিনি' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত 'মিস্ষ্টান্বিতা' । ১লা জুন ১৯৩৫। দ্বিতীয় কবিতা 'স্ফুলিঙ্গ' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত 'স্ফুলিঙ্গ' । ১২ নভেম্বর ১৯৩৫ সন । তৃতীয় কবিতা 'প্রহাসিনী' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত 'ভাই দ্বিতীয়া' ।
কবির সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্কে খাবারই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিল । বরানগরে গেলেই বলতেন, "খাওয়াচ্ছ কবে?"। রান্নার কথা বললেও সঙ্গে সঙ্গে নিষেধও করতেন । কিন্তু কবির অন্তরের স্নেহ কাঙাল মনটি আসলে কৃত্রিম নিষেধ করত । বরানগরে লাহিড়ী বাড়িতে কবি গিয়েওছেন বার কয়েক । তবে এলেই লাহিড়ী বাড়িতে সাজো সাজো রব । শরৎচন্দ্র নিজে বসে রান্নার তালিকা তৈরি করতেন । সেই মতো ব্যবস্থা করতেন । যে কদিন কবির খাবার তৈরি হতো সে কদিন পাচকের প্রবেশ নিষেধ ছিল । ভোররাত্রে উঠে ছোট বোন দেবরানী দেবীকে সহযোগী করে পারুলদেবী রান্না করতেন । সকাল দশটায় খাবার যাবে শশী ভিলায় । একটি লম্বাটে গড়নের ট্রাঙ্কে পরপর খাবার সাজানো হতো । সাথে কাঠের বাক্সে বরফ দেওয়া কিছু ফল ও ফুল সাজিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন দুই নাতনি । যথাসময়ে অশ্বিনী বাবু বা কবির শ্যালকপুত্র বীরেন বাবু গাড়ি নিয়ে আসতেন । সবাই মিলে খাবার নিয়ে পৌঁছতেন । শশী ভিলায় উপস্থিত অনেকেই যেমন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, অমল হোম, প্রমথ চৌধুরী ইত্যাদি গুণীজন ব্যক্তিত্ব ।
যে বৎসর কবির সাথে তার নাতনিদের পরিচয় সেই বছরই কবির আমন্ত্রণে পারুলদেবী ও তার দুই ভাই এবং বোন গেলেন শান্তিনিকেতন পূজার সময় । চাঁদের আলোয় শান্তিনিকেতন প্রাঙ্গণ ভেসে যাচ্ছে । শ্যামলীর সামনে জ্যোতির্ময় পুরুষ দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা করলেন চার ভাই বোনকে । এমন আন্তরিক অভ্যর্থনা, অপার স্নেহ, সীমাহীন আনন্দে আত্মহারা চার ভাইবোন । কোথা দিয়ে আট দিন কেটে গেছে তারা বুঝতেও পারেননি । পারুলদেবী সেখানে গিয়েও তার দাদুকে রেঁধে বেড়ে খাইয়েছেন । কবির আমন্ত্রণে একবার ভাইফোঁটা দিতে গিয়েছিলেন । স্বর্ণকুমারী দেবী মানে কবির বড়দি চলে যাওয়ার পর থেকে আর তাকে ফোটা দেবার কেউ ছিলনা । কবি খুব আনন্দ পেয়েছিলেন অনেক লোককে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন । পারুলদেবীর বোন দেবরানী দেবী সেই স্বর্ণালী দিনগুলির স্মৃতিচারণায় বলেছেন, "খুব ভোরে ফোঁটা দিও"। দুই বোন রেশমের ধুতি-চাদর, শ্বেতপাথরের রেকাবি গেলাস, পায়েসের বাটি আর অগুরু চন্দন ও মিষ্টি নিয়ে খুব ভোরে কবির বাড়িতে উপস্থিত হলেন । ফোঁটা দিলেন । কবি বলেছিলেন প্রদীপটা নিভিয়ো না, নিভাতে নাই ।
কবির স্নেহের যে প্রদীপ দুই বোনের মনে জ্বলেছিল তা সারা জীবন তাদের মনের অন্ধকার কে সরিয়ে চির অনির্বাণ হয়েই জ্বলেছিল ।
পারুলদেবীর সাথে চিঠিপত্রে নানা বিষয়ে কবি নানা কথা হয়েছে । ব্যক্তিগত কথা, কবির স্মৃতিচারণ, উপহাস, রান্না প্রসঙ্গ সবকিছু । এর মধ্যে কবির স্নেহ কাঙাল মনটি ফুটে ওঠে । যাদেরকে আপন করে নিতেন, তাদেরকে আবদারে অস্থির করে তুলতেন । অন্তহীন স্নেহে ভরিয়ে দিতেন । শান্তিনিকেতন থেকে রানী মহলানবিশ কে চিঠিতে লিখেছেন,
কল্যাণীয়াসু
পারুল এসে খুব ধুমধাম করে ভাইফোঁটা দিলে, তার খরচ কম লাগেনি । আমার মনটাকে করুণায় ব্যথিত করে কাল সে চলে যাবে । আমার নির্জন দিনের স্রোতে এরা ভেসে আসা ফুল ফলের মতো ।
ভাই দ্বিতীয়া
১৩৪৩
কবি
ডাঃ গার্গী দাস বক্সী
ডক্টর গার্গী দাস বক্সী অল ইন্ডিয়া রেডিও বি-হাই শ়়ংসা প্রাপ্ত শিল্পী এবং বঙ্গীয় সঙ্গীত পরিষদ এর সংগীত বিভাকর ।
এছাড়াও উনি শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড এর অনুমোদিত রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী এবং Indian Council for Cultural Celations ও Eastern Zonal Cultural Centre এর তালিকাভুক্ত সংগীতশিল্পী । 'গীতবিতান' সংগীত শিক্ষায়তনের বালিগঞ্জ শাখার প্রাক্তন সংগীত শিক্ষক ডঃ বক্সী ভারত সরকারের সাংস্কৃতিক মন্ত্র থেকে Senior Fellowship পুরস্কারপ্রাপ্ত । বর্তমানে উত্তর দিনাজপুরের মহানন্দা কলেজ অফ এডুকেশনে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ।
দূরদর্শন এবং তারা মিউজিক, ইটিভি, রূপসী বাংলা ইত্যাদি বিভিন্ন চ্যানেলে সংগীত পরিবেশন করেছেন । 'সূচনা' (মিউজিক ২০০০ সংস্থা থেকে প্রকাশিত), 'চোখের আলোয় দেখেছিলেম' (Concord থেকে প্রকাশিত), এবং 'রাগে অনুরাগে' (রাগরঞ্জন থেকে প্রকাশিত) - এই নামে ওনার তিনটি সংগীত অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে । ডাক্তার গার্গী দাস বক্সী শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন ডঃ প্রদীপ ঘোষ, প্রয়াত শ্রীমতি মায়া সেন, প্রয়াত গোপেশ্বর চক্রবর্তীর শিষ্য প্রয়াত পরেশ চন্দ্র চক্রবর্তী, শ্রীমতি স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত, শ্রী তপন বসু'র মতো শ্রদ্ধেয় শিল্পীদের ।




Comments
Post a Comment